দ্রোহ অনলাইন ডেস্ক
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এক বর্বর সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে গণহত্যার শুরু করেছিল, পরবর্তী নয় মাস ধরে তা অব্যাহত ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায়।
আজ বৃহস্পতিবার সেই ২৫ মার্চ। বাঙালি জাতি তথা মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত বেদনাবিধুর রাত ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের এ রাতে বাঙালির জীবনে এক বিভীষিকা নেমে এসেছিল। বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাপুরুষের মতো মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।
আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য ল্েয ঢাকা ও এর আশপাশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া কুলাঙ্গাররা।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। এ অপারেশনে নিরপরাধ, ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এ অপারেশনে নিহতের সংখ্যার বিষয়ে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র-এর সভাপতি, ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা বলা একটু কঠিন।
তিনি বলেন, তবে ২৫ মার্চ রাত থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালে ঢাকায় সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করা হয়। ‘ঢাকায় গণহত্যার প্রথম পর্ব (১৯৭১ : ২৫ থেকে ৩১ মার্চ)’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি থেকে জানা যায়- ২৫ মার্চ কালরাত্রি এবং এর পরবর্তী কয়েকদিন ঢাকা শহরজুড়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ইপিআর বাহিনী, ঢাকা পিলখানা, প্রেসিডেন্ট হাউস, গভর্নর হাউস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, সার্ভেন্ট কোয়ার্টার, রমনা কালীমন্দির, রমনা থানা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পুরানা পল্টন, পুরান ঢাকার নয়াবাজার, বাবুবাজার, কোতোয়ালি থানা, কাঠেরপুল, লোহারপুল, মানিকটোলা, শাঁখারীবাজারে বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটে।
এ গবেষণা কর্মের এক জায়গায় গবেষক রীতা ভৌমিক উল্লেখ করেছেন, ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে অনেক পুলিশ সদস্য শহীদ হন। এসআই, সুবেদার, নায়েক, হাবিলদার, সিপাহিসহ প্রায় দেড়শ’ পুলিশ সদস্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা জগন্নাথ হলের শিক-ছাত্র-কর্মচারীদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহীদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জিসি দেব), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও জগন্নাথ হলের হাউস টিউটর অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, মধুর ক্যান্টিনের মধুসূদন দে (মধু দা ) এবং ২৫ মার্চ গুলিবিদ্ধ হয়ে চার দিন পর মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্রদের মধ্যে ৪৫ জন শহীদ হন।
জগন্নাথ হলের কর্মচারীদের মধ্যে পাঁচজন শহীদ হন। জগন্নাথ হলে ২৫ মার্চ রাতে তিনজন অনাবাসিক ছাত্রও শহীদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে সাতজন শহীদ হন। ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সাতজন ছাত্র ও দু’জন কর্মচারী শহীদ হন। রোকেয়া হলে ৩৩ জন শহীদ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ শিক, ১০১ ছাত্র, একজন কর্মকর্তা, ২৮ কর্মচারী ও মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দে, তার স্ত্রী, ছেলে ও পুত্রবধূকে হত্যা করে পাকবাহিনী।
রাত ১২টার পরপরই একসঙ্গে ঢাকার পিলখানার ওপর ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা আক্রমণ চালায়। বাঙালি ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সদস্যরা প্রাণপণে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালান। শহীদদের মধ্যে রয়েছেন- সুবেদার হেড কার্ক আলা বখ্স, সুবেদার হেড কার্ক দলিল উদ্দিন, সুবেদার কোয়ার্টার মাস্টার হাসমত উল্লাহ, ল্যান্স নায়েক আবুল বাশার প্রমুখ। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন লিখেছেন, ‘সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা এবং আরও তিন হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হয়। বাংলাদেশ হয়ে ওঠে শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।’
গবেষক রীতা ভৌমিক বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে ও ২৬ মার্চ ঢাকার নীলতে, পলাশী, রেলওয়ে বস্তিগুলোতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে অনেক বাঙালি শহীদ হন। তবে তাদের সংখ্যা কত, তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। নিউমার্কেটের কাঁচাবাজারের সব কসাইকে হত্যা করা হয়। ঢাকা শহর থেকে যখন লোক পালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জিঞ্জিরার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তাদের ওপর কামান দাগায় পাকসেনারা। এভাবে বহু লোককে হত্যা করা হয়। সদরঘাটের টার্মিনালে মধ্যরাতে ও ভোররাতে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদপে চ‚ড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান।
সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যে কোন মূল্যে শত্রæর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহŸান জানান।
বঙ্গবন্ধুর এই আহŸানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।