আবরার ফাহাদ হত্যার ৫ বছর: ছেলে হত্যার কথা মনে হলেই শিউরে উঠি

0
49

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

আজ (৭ অক্টোবর) আবরার ফাহাদ হত্যার ৫ বছর। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর বর্বর ও নৃশংস নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ। বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আবরার।

সকালে কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের পাশে আবরারের বাড়িতে গেলে মা রোকেয়া খাতুনের সাথে কথা হয়। বাড়িতে তিনি একাই ছিলেন। আবরারের একমাত্র ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বুয়েটে যন্ত্র কৌশলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আবরার ফাহাদের মৃত্যবার্ষিকী উপলক্ষে বুয়েটে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তার বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকাতে গেছেন।
কথা হলে অশ্রæসিক্ত চোখে আবরারের মা রোকেয়া খাতুন বলেন,‘এইদিন একই বারে ছেলেকে সকালে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। বিকালে বুয়েটে পৌছায়। এরপর তাকে ছাত্রলীগের ছেলেরা ডেকে রাতভোর নির্যাতন করে হত্যা করে আবরারকে। তারা ছাত্রলীগ করলেও তারই কয়েকজন বন্ধু ছিল। তারাও একটি বারের জন্যও ফোনে জানায়নি ছেলেকে হত্যার বিষয়ে।’

এ সময় শোকেসের গøাস সরিয়ে একটি ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইল ফোন বের করে দু হাতে নেড়ে চেড়ে বললেন, এগুলো ছেলের। যতেœ রেখেছি আজও। আবার খুব যতেœ সেগুলো শো কেচের ভেতরে রাখলেন। এবার বললেন, জানো বাবা আজ যদি আমার ছেলে বেঁচে থাকতো তাহলে চাকুরি করতো। আরও কত কি হতো। এভাবেই স্মৃতিচারণ করতে থাকেন মা রোকেয়া খাতুন।

বললেন,‘ছেলের আম্মু আম্মু ডাক এখনও কানে বাজে। ভুলতে পারি না। কিভাবে ভুলবো। এই সন্তানকে ভোলার নয়। তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটা মনে হলেই শিউরে উঠি।’

আরও পড়ুন – খোকসার একটি মডেল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ দুই মাস অনুপস্থিত

তিনতলার বাড়ির নিচতলাতে থাকেন তারা। একটি কক্ষ বেশ পরিপাটি করে সাজানো। খাটের একপাশে বড় একটি শো কেচ। সেটির পাশে দাড়িয়ে রোকেয়া খাতুন বললেন, ছেলের বুয়েটে যে বিছানায় থাকতো। সেখান থেকে সব কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনও নেওয়া হয়েছে। সেগুলো বের করে দেখিয়ে আবারও কেঁদে উঠলেন তিনি।

শো কেচের ভেতর হাতঘড়ি থেকে শুরু করে ব্যাগ, বইপত্র, প্রসাধণী,আইডিকার্ডসহ আরও অনেক কিছুই যতœ করে তুলে রেখেছেন। জুতা, একটি গোলক, পোশাক, জায়নামাজ ও তজবি রয়েছে। কিছু চকলেট দেখিয়ে বললেন, এগুলো পেয়েছিলেন। আবরার ঘুমানোর সময় চকলেট মুখে দিয়ে ঘুমাতো। সেগুলোও পাঁচ বছর ধরে রেখেছেন। হাতঘড়ির কাটা বন্ধ হয়ে গেছে। সেটিও দেখালেন আর বললেন,আর কতদিন চলবে।

রোকেয়া খাতুন জানাচ্ছিলেন, তার ছেলে সব সময় দেশের ভালোর জন্য লিখতেন। দেশ নিয়ে ভাবতেন। দেশের স্বার্থে ভালো কিছু লিখেই তিনি একটি দলের কাছে শত্রæ হয়ে গিয়েছিল। আবরারতো কোন রাজনীতি করতো না। তাহলে কেন তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর যারা হত্যা করলো তারাতো তারই বন্ধু ছিল। তারা কি দেশের ভালো চাইতো না প্রশ্ন করছিলেন রোকেয়া খাতুন।

হত্যা মামলার রায় হয়েছে। আসামিদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কেউ কেউ পলাতক রয়েছে। সব আসামিদের দ্রæত ফাঁসি কার্যকের জোর দাবি জানান মা।

এদিকে গতকাল রবিবার (৬ অক্টোবর) রাত ১০টার দিকে আবরারের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ ফেসবুকে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন ‘২০১৯ সালের আজ অর্থাৎ ৬ অক্টোবর ভাইয়া ঢাকাতে যায়। ২৬ই সেপ্টেম্বরে কুষ্টিয়াতে আসার পরেই ইলিশ আর ভারতের সাথে চুক্তি নিয়ে দুটি পোস্ট দিয়েছিলো। সেদিন আম্মু নিজে ভাইয়াকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসছিলো। এরপর মাত্র ১৩-১৪ ঘন্টার মধ্যে ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। আর ২০ ঘণ্টা পরই বাসায় আসে মৃত্যুর সংবাদ।

সেদিন সকালে যাওয়ার আগে ৯টার দিকে আম্মু আমাকে ডেকেছিলো। ভাইয়া চলে যাচ্ছে, ওঠ। কিন্তু ভাইয়া বলে, ‘না থাক, অনেক রাতে ঘুমাইছে ঘুমাতে দেও। আমি চলে গেলাম। তুই বেশিদিন থাকিস না তাড়াতাড়ি ঢাকা চলে আসিস।’ যাওয়ার আগের রাতে আম্মুকে ভাইয়া বলেছিলো, ‘আম্মু অনেক ছারপোকা কামড়ায়। পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দেও তো। কোনো দাগ হয়ে গেছে নাকী? আচ্ছা তোমার কাছে কী এমন কোনো ওষুধ আছে যা লাগালে আর কামড়াবে না আমাকে?’
It has been a long time brother.Õ’
এর দুইঘন্টা পর আরেকটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে একটি অডিও পোষ্ট দিয়ে তিনি লেখেন “৫ বছর আগের এই রাতে ভাইয়ার শেষ ফোন কল ছিল এটি, ভাইয়ার এক স্টুডেন্টের মায়ের সাথে। এর পরেই ভাইয়াকে মারতে শুরু করে। এই রেকর্ড থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় ওই সময়ে ঠিক কী পরিমাণ ভয় ভাইয়া পেয়েছিলো। কিন্তু খুনিগুলো তাও কোনো দয়া দেখায় নি। অথচ যারা এই খুনিদের তৈরি করেছিল, তাদেরকেই ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে এখন!

৬ অক্টোবর ২০১৯ এর রাত ৯টা ৪০ এর কথোপকথন। আম্মু ১১টা ১৬ তে দুইবার ফোন দিলেও আর ধরতে দেয়নি।
ঢাকায় আবরারের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের উদ্দেশ্যে ঢাকায় গেছেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। তিনি ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামীদের গ্রেফতারসহ যেসব আসামি কারাগারে রয়েছে তাদের রায় দ্রæত কার্যকরের দাবি জানান। এদিকে দিবসটি পালন উপলক্ষে কুষ্টিয়ায় তেমন কোন কর্মসূচি রাখা হয়নি। সকালে গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কায় তার কবরস্থানের দোয়া করেন মা রোকেয়া খাতুন।