স্টাফ রিপোর্টার
চাকুরি আছে, বেতন নেই। ১০ বছরেও সাতটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভকেশনাল শাখা এমপিও ভুক্ত হয়নি। ফলে এ সব প্রতিষ্ঠানের অর্ধশত শিক্ষকের পরিবার খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠান গুলো কবে এমপিও ভুক্ত হবে তারও নিশ্চয়তা নেই। দীর্ঘ দিন বেতন না পাওয়ার হতাশা থেকে ইতোমধ্যে এক ল্যাব সহকারী আত্মহত্যা করেছেন।
সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ার খোকসার উপজেলার সেনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়, খোকসা জানিপুর বালিকা বিদ্যালয়, শোমসপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঈশ্বরদী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও শোমসপুর বালিকা বিদ্যালয়ের ভকেশনাল শাখা এমপিও ভুক্ত হয়নি। ফলে ৫ থেকে ১০ বছর ধরে এ সব বিদ্যালয়ের ভকেশনাল শাখার প্রায় অর্ধশত শিক্ষক বেতনসহ সরকারের সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইতোমধ্যে এনটিআরসির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের অধিকাংশই প্রতিষ্ঠানের এমপিও না থাকায় চাকুরি ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকেই শুনেই যোগদান করেনি।
প্রতিদিন সকাল হলেই স্কুলে যাওয়ার তারা, সন্তান ও নিজের পেটে ক্ষুধার আগুন নিয়ে শিক্ষক সেজে স্কুলে যান। সারাদিন নিজের প্রতিষ্ঠানে কর্মব্যস্ত সময় পার করেন। কিন্তু‘ শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভকেশনাল শাখার ল্যাব সহকারী শামীম হোসেনের পাঁচ বছরেও বেতন হয়নি। সে খোকসা উপজেলা সদরের কালীবাড়ি পাড়ার আব্দুস সালামের ছেলে। পাঁচ বছর বয়সী বড় মেয়ে শাম্মী, আড়াই বছরে বয়সের ছোট মেয়ে সামিয়া, স্ত্রী সুবর্ণা আর বাবা মাসহ ৬ জনের সংসারে শামীমই একমাত্র আয়ের মানুষ। কয়েক মাস ধরে স্কুলে যাওয়া আসার খরচের মাসিক ৩ হাজার টাকা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার কাছে এ যেনো মরার উপর খারা ঘা হয়ে দাড়িয়েছে।
শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কোম্পানীর ভালো বেতনের চাকুরি ছেড়ে ২০১৬ সালে শামীম গ্রামে ফিরে আসেন। উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভকেশনাল শাখার ল্যাব সহকারীর চাকুরি নেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন অল্প সময়ের মধ্যে এমপিওসহ সরকারী অংশের মাসিক মোটা টাকা বেতন হবে। বেতন আর হয়নি। এমন কী প্রতিষ্ঠানই এমপিও হয়নি। এক পর্যাযে স্কুল থেকে তাকে মাসিক ৩ হাজার টাকা খরচ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু চলতি বছরের সে টাকাও দেওয়া হচ্ছে না। এখন খেয়ে না খেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের পদ্মা নদীর তীরের সেনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভকেশনাল শাখায় ল্যাব সহকারী পদে চাকুরি নিয়েছিল সোহাগ হোসেন। চার বছরেও তার এমপিও বা বেতন কোনটাই হয়নি। দীর্ঘদিন বেতন না পাওয়ার হতাশা থেকে মঙ্গলবার (৫ মার্চ) রাতে সে নিজের ঘরে ঘাস মারা বিষপাণ করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। প্রায় ২৪ ঘন্টা চিকিৎসার এক পর্যায়ে বুধবার রাতে তার মৃত্যু হয়। পুত্র শোকে পাথর বনে গেছেন পিতা শহিদুল ইসলাম দম্পতি।
শামীম জানান, পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করার পর বিদ্যালয়ের সভাপতি আনছার আলী জানিয়েছিলেন, অল্প সময়ের মধ্যে ২২/২৩ হাজার টাকা বেতন হবে। আর যতদিন এমপিও বা বেতন না হয় ততদিন বিদ্যালয় থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। কিন্তু ৫ বছরেও বেতন হয়নি। স্কুল অংশ থেকে মাঝে মধ্যে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হতো। এ বছরে সে টাকা দেওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি জানান, নিজের সন্তানদের পেটের ভাত যখন দিতে পারেন না তখনই আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সন্তানের কথা ভেবে আর আত্মহত্যা করতে পারেন না। সদ্য আত্মহত্যা করা সোহাগের মত তিনি (শামীম) তিন বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এসব কথা বলার সময় শামীমের দুই চোখ বেয়ে অঝড়ে জল পরছিল।
সেনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভকেশনাল শাখার ল্যাব সহকারী সোহাগের বাবা শহিদুল ইসলাম ছেলের শোকে শর্যাশায়ী হয়ে পরেছেন। তিনি জানান, টাকা দিয়ে ছেলের চাকরি দিয়ে ছিলাম। তার পরেও ছেলে হারালাম। বেতন না পাওয়ার হতাশা থেকে তার ছেলে আত্মহত্যা করেছে। তারা স্কুল কমিটির প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ভকেশনাল শাখা কর্মচারীদের বেতন না পাওয়া দুঃখ জনক। এমপিও ভুক্তির জন্য ছাত্র ভর্তি ও পাশের হারের ক্যায়টরিয়া পুরন না হওয়ায় উপজেলা ৭টি বিদ্যালয়ের ভকেশনাল শাখার এমপিও হচ্ছে না। এ ছাড়া শামীম তার মাধ্যমে নিয়োগ নেয়নি বলেও জানান।
তিনি আরো জানান, এনটিআরসি দুই দফায় তার স্কুলে ৪ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে ছিল। কিন্তু এমপিও না থাকায় ও বেতন না হওয়ার বিষয় নিশ্চিত হয়ে ওইসব শিক্ষকরা যোগদান না করে চলে গেছে। আর আসেনি।
শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি আনছার আলীর সাথেও কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন ধরেন নি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নাজমুল হক সেনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নন এমপিও কর্মচারীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে আতকে ওঠেন। তিনি বলেন, এতবড় ঘটনা কিন্তু প্রধান শিক্ষক তাকে জাননি। পর্যায় ক্রমে সব ভকেশনাল শাখার এমপিও হবে। তবে কবে হবে তা তার জানা নেই।
এ কর্মকর্তা বলেন, টিউশনি করলেও জীবন চলে। টাকার জন্য একজন শিক্ষিত লোক আত্মহত্যা করবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বিষয়টি জানার চেষ্টা করবেন বলে জানান।