খোকসায় শিশু ধর্ষন চেষ্টার ঘটনা সালিশে রফা

0
129

স্টাফ রিপোর্টার

প্রবাসী মামা বাড়ি ফিরেছেন। তাই মায়ের সাথে মামাকে দেখতে আসে ওই শিশু। এসেই বৃদ্ধের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সালিশ বানিজ্য শুরু করেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। নিজের বাড়িতে সালিশ বসিয়ে যৌন নির্যানের চেষ্টাকারীকে ২ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য করেন। কিন্তু জরিমানা পরিশোধের সময় শিশুর নানার হাতে ৯০ হাজার টাকা দিয়ে স্ট্যাম্পে করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সালিশের মাতুব্বরদের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, খোকসা উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের শিমুলিয়া গ্রামে ৫ বছর বয়সের ওই শিশু নানা বাড়িতে বেড়াতে এসে ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধে যৌন লালশার শিকার হয়। যৌন নির্যাতন কারী ৮ সন্তানের জনক। শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা।

এ ঘটনার দিন ১০ নভেম্বর সন্ধায় শিশুটির নানা খোকসা থানায় অভিযোগ করেন। খবর পেয়ে যায় শিমুলিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ, ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বর আইন উদ্দিন চক্র। তারা সামাজিক ভাবে সমাধানের কথা বলে বিলজানি বাজারের পাশে সাবেক ওই চেয়ারমনের বাড়ির বৈঠক খানায় সালিশী বসায়। সেখানে হাজির করা হয় শিশুর নানা ও বাবাকে। উপস্থিত হন যৌন নির্যাতনকারীর বৃদ্ধের বিয়াই (ছেলের শ্বশুর) হাসান আলীসহ হাতে গোনা কয়েকজন। চরম গোপনীয়তার মধ্যে দীর্ঘ সময় আলোচনার পর ধর্ষনের চেষ্টাকারী বৃদ্ধকে ২ লাখ টাকা জরিমানা ধার্যকরে রায় ঘোষনা করা হয়। ৫ দিনের মধ্যে সালিশের প্রধান সাবেক চেয়ারম্যান মজিদের হাতে জরিমানার টাকা পৌছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

নির্দ্ধারিত সময়ে আগেই সোমবার (১৩ নভেম্বর) শিশুর নানা ও বাবার উপস্থিতিতে ধর্ষন চেষ্টাকারীর পরিবার জরিমান মধ্যে ১লাখ ৯০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। শিশুটির নানা ও বাবার হাতে সেই টাকা থেকে মাত্র ৯০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বাদসাধেন শিশুর নানা। তাকে জানানো হয় বাঁকী ১ লাখ টাকা পুলিশ ও উপরের লোকদের ম্যানেজ করতে দেওয়া হবে। এক পর্যায়ে সালিশ চক্রের নেতা সাবেক চেয়ারম্যান চাপ সৃষ্টি করায় ভুক্তভোগীরা চলে আসতে বাধ্য হয়।

সালিশের নামে প্রতারণার ঘটনায় শিশুটির নানা ক্ষুদ্ধ হন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কর্মীদের কাছে সালিশ নিয়ে তার প্রতিক্রিয়ার কথা জানান। ইতোমধ্যে ৩ মিনিট ৬ সেকেন্ডর সেই বক্তব্যটি ভাইরাল হয়েছে। এই ভিডিও তে তিনি বারবার সালিশের প্রধান সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান মেম্বর সম্পর্কে বিষদাগার করছেন।

গত মঙ্গলবার সবেজমিন গিয়ে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে কথা বলা হয়। এই সালিশের জরিমানা আদায় ও আত্মসাতের ঘটনাটি সবাই শুনেছেন। শিমুলিয়া ইউনিয়নের জুড়েই জাল বিস্তার করে রেখেছে এই সালিশ চক্র। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হলেও সেখানে সালিশের সুযোগ খোঁজেন এই সাবেক চেয়ারম্যান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা। সবাই মুখ খুলতে ভয় পান।

মোটা টাকায় শিশু ধর্ষন চেষ্টার ঘটনাটি রফা পর ও টাকা না পেয়ে শিশুটির নানার দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও ভাইরালের ঘটনার পর এ নিয়ে আর মুখ খুলছে না দুই পরিবার।

শিশুটির মামি জানান, প্রবাসী মামা বাড়ি ফেরায় মায়ের সাথে ৫ বছর বয়সী শিশুটিও নানা বাড়ি আসে। শুক্রবার সকালে সবাই সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এ সময় ওই শিশুটি মাঠের মধ্যে দিঘিতে বেড়াতে যায়। এ সুযোগে হোসেন আলী ওই দিঘির ইজারাদারদের মাছ পাহাড়ার কুড়ে ঘরে শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষনের চেষ্টা করে। এ সময় মাঠের কৃষকরা ঘটনা স্থলে উপস্থিত হলে শিশুটি ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পায়।

তিনি আরও স্বীকার করেন এ ঘটনা নিয়ে সালিশ ও লেনদেন হয়েছে। সালিশের সেই টাকা থেকে সামান্য টাকা মেয়ের বাবাকে দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

শিশু ধর্ষনের অভিযোগে অভিযুক্তকে তার বাড়িতে পাওয়া যায়। তাকে সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে দিতে রাজি হয়নি পরিবার। তবে এরই মধ্যে বৃদ্ধ জানান, বিলের পানিতে পাট পচন দেওয়া নিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। তারই জের ধরে তাকে মিথ্যা বিচারের মুখমুখি করা হয়েছে। জরিমানাও করা হয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন সালিশের মাতুব্বরদের বিরুদ্ধে। তার দাবি সালিশের নামে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। অনেকটা জোর করেই বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সালিশ চক্র। তবে টাকার পরিমান বলতে রাজি হননি তিনি। তার মানসন্মান নষ্ট করেছে। তিনি এর বিচার দিয়েছেন আল্লাহর কাছে।

চায়ের দোকানী আব্দুল রাজ্জাক সালিশে রফার টাকা লেন-দেনের সময় উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেন। সেখানে সাবেক চেয়ারম্যান মজিদ, মেম্বর আইন উদ্দিন ও মেয়ের নানাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন বলে নিশ্চিত করেন।

ইউপি সদস্য আইন উদ্দিন শিশু ধর্ষনের চেষ্টার ঘটনার সালিশ করার কথা স্বীকার করেন। শিশুটির শরীরে ধর্ষনের আলামত পাওয়া যায়নি বলে তিনি নিশ্চিত করেন। তার পরেও সালিশ করেছেন। জরিমানা করেছেন ২ লাখ টাকা।

ইউপি সদস্য আরো জানান, সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে ওই শিশুর পরিবারের লোকেরা বিচার নিয়ে গিয়েছিলেন। এ সময় চেয়ারম্যান তাদের (শিশুর নানা) দিয়ে থানায় অভিযোগ করাণ। থানা পুলিশের এসআই চাঁদ আলীর নেতৃত্বে গ্রামে পুলিশ আসে। রবিবার (১২ নভেম্বর ) দুই পক্ষ নিয়ে সাবেক ওই চেয়ারমম্যানের বাড়িতে সালিশ হয়। প্রথমে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হলেও ১লাখ ৯০ হাজার টাকায় নিস্পত্তি হয়। জরিমানার টাকা পরিশোধের সময় দুই পক্ষ ও সালিশের মাতুব্বররা ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করেছেন। বিলজানি বাজারের সাথে কাশেম আলীর বাড়িতে লেনদেন হয় বলেও তিনি স্বীকার করেন। পরিবারের পক্ষ থেকে শিশুটির নানার ভিডিও ভাইরাল করায় তিনি ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রীয়া জানান।

শিমুলিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল মজিদ বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিলো। তিনি নিজের বাড়িতে তাদের নিয়ে বসে মিল করে দিয়েছেন। থানায় আপস নামা দেওয়ার জন্য স্ট্যাম্পে লিখিত হয়েছিল। সেখানে তিনি সাক্ষর করেছেন। সালিশে জড়িমানাও করা হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। এ ছাড়া কোন টাকা পয়সা লেনদেনের সাথে তিনি সম্পৃক্ত নন। এ নিয়ে যা হয় হোক। তিনি চিন্তিত নন।

শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস জানান, শিশুধর্ষন চেষ্টা ও সালিশের বিষয়ে তিনি শুনেছেন। সালিশে মোটা অংকের টাকা লেনদেন হয়েছে বলে খবর পেয়েছেন।

পরিষদের বর্তমান এই চেয়ারম্যান স্বীকার করেন, তার ইউনিয়ন জুড়েই যুগযুগ ধরে সালিশী প্রথা চালু রয়েছে। নারী সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সালিশ বেশী হয়। তার সময়ে সালিশ প্রথা কিছুটা কমাতে পেরেছেন। তবে এ সামাজিক ব্যাধি সারাতে সময় লাগবে।

খোকসা থানা পুলিশের এসআই চাঁদ আলীর সাথে কথা বলা হলে তিনি বলেন, শিশুর পরিবারের পক্ষ থেকে কোন লিখিত অভিযোগ করেনি। মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি প্রাথমিক ভাবে তদন্ত করেছেন। ভুক্তভোগীরা পরে আর তার সাথে যোগাযোগ করেনি। দুই পক্ষ নিজেরা নিজেরা। তিনি এ ব্যাপারে আর খোজ করেননি।

থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা হাবিবুল্লাহ বলেন, শিশুর পরিবার প্রথমে এসেছিল। পরে আর তারা যোগাযোগ করেনি। লিখিত দিলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।