স্টাফ রিপোর্টার
ছোট একটি তালায় ঘনবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন পার করেছেন সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল। অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত এই কর্মকর্তার ভালো চিকিৎসাও হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে অসুস্থতাও বেড়েছে। বেড়েছে মানসিক বিকার। অন্ধকার কক্ষে থাকেন বিবস্ত্র হয়ে। খাবার খান নিজের ইচ্ছা মত। প্রলাপ বকেন শুধু কর্মস্থলের প্রতি অনিহার বিষয় নিয়ে।
সর্বশেষ সাভার পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত অবস্থা থেকে ২০১৬ সালে বাধ্যতা মূলক অবসরে পাঠানো হয় মোস্তফা কামালকে। এরপর থেকে নিকট সহদরের কাছে গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছেন তিনি। বিনা চিকিৎসায় অযন্তে অবহেলায় ঘরের অন্ধকার কক্ষে জীবন কাটছে তার। পরিবারের অভিযোগ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। জন প্রতিনিধিরা বলছেন পরিবারের অবহেলা রয়েছে।
খোকসা উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চান্দট গ্রামের স্কুল শিক্ষক আফতার মন্ডল ও জহুরা খাতুন দম্পতির ৯ সন্তানের মধ্যে মোস্তফা কামাল দ্বিতীয়। ছেলে বেলা থেকে দারুন মেধাবী ছিলেন। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শেষ করেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন শৈলকুপা উপজেলায়। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স ও মাষ্টার্স শেষ করার পরের বছর ১৯৯১ সালে আণবিক শক্তি কমিশনের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে সরকারী চাকুরি পেয়ে যান। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পারমানু চিকিৎসা কেন্দ্রে যোগদান করেন। অল্প সময়ের মধ্য কর্মস্থলে সুনাম অর্জন করলেও বিষাদগ্রস্থ হয়ে পরেন। মানসিক জটিলতার কারণে ৪ বছরের মাথায় ১৯৯৪ সালে তাকে পরমানু শক্তি গবেষনা প্রতিষ্ঠান সাভারে বদলি করা হয়। মানসিক অবস্থা ক্রমাগত জটিল আকার ধারণ করায় ২০১৬ সালে তাকে বাধ্যতামূল অবসরে পাঠানো হয়। পেনশনের অর্ধ কোটি টাকা ব্যাংকে রাখা হয়। এ ছাড়া প্রতিমাসে পেনশন হিসেবে প্রায় ১৯ হাজার টাকা পেতে থাকেন তিনি। কিন্তু ভাইদের পাওয়া না পাওয়ার হিসাবের গড়মিলে সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার চিকিৎসা ও পরিচর্যায় ভাটা পরে। টানা তিন বছর রাখা হয়েছে ঘরবন্দি করে। শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খবার দেওয়ার জন্য ঘরের দরজার তালা খোলা হয়। ঘরের মেঝেতেই প্র¯্রাব পায়খানে করেন। অনাদর আর অবহেলা ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছেন মেধাবী বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
মানসিক ভাবে অসুস্থ সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার দেখ-ভালের দায়িত্ব ছোট ভাই আমজাদ হোসেনের উপর পরেছে। ইতোমধ্যে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মা জহুরা খাতুন ছেলের চিন্তায় অন্ধ হয়ে ৬ বছর আগে মারা গেছেন। একদিকে বিনা চিকিৎসা অন্যদিকে অবহেলায় মানসিক বিকারগ্রস্থ মোস্তফা কামালে শারীরক অবস্থার দ্রæত অবনতি হচ্ছে। এখন সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে কৃষককের ফসল তছরুপ করেন। যে কোন বাড়ির মধ্যে ঢুকে পরেন। এতে করে মহিলারা ভয় পান। এমন অভিযোগেই তাকে ঘরবন্দি করে রাখা হয়েছে।
ঘনবন্দি বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার খোজ নিতে চান্দট গ্রামে তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়। বাড়ির একটি আধাপাকা ঘরের দরজায় ছোট্ট একটি তালা দিয়ে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। অসুস্থ সাবেক এই কর্মকর্তা দেখ-ভালের দায়িত্বে থাকা আমজাদ হোসেন দরজা খুলে দিলেন। সাংবাদিক আসছে শুনে বললেন, জানালায় আসতে বলো। পরিবারের লোকদের সাথে ঘরে ঢুকে দেখা গেলো, অনেকটা আয়েসী ভঙ্গিতে তিনি চৌকির উপর শুয়ে আছেন। পাশেই সাড়িবদ্ধ কয়েকটি টিনের বাক্স রাখা। ঘরে বৈদতিক পাখা বা আলোর ব্যবস্থা নেই। প্রচন্ড গরমের মধ্যেও কোমর থেকে পা পর্যন্ত একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে শুয়ে আছেন। শুদ্ধ ভাষায় স্বাভাবিক সব প্রশ্নে উত্তর দিচ্ছিলেন। চাকুরি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই অনেকটা প্রতিবাদের সাথেই বলে উঠলেন। “চাকরিতো করা যাবেনা। চাকরি করা মহাপাপ। পৃথিবীর মানুষ যারা তারাতো চোর ডাকাত পিচোট। আমি কেবল ভালো মানুষ। আর সব চোরডাকাত পিচোট। এইজন্যই চোর ডাকাত পিচোট দের সঙ্গে চাকরি করা এটাতো আমার উচিত না। অফিসের সাথে সরকারের সাথে সমস্ত কিছুবাদ।” স্বাভাবিক কথপোকথনের ফাঁকে এক সময় উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন বেড়িয়ে যাও।
সাবেক ওই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার বড় ভাই নজরুল ইসলামও সাবেক সেনা সদস্য। তিনি দুষলেন তার ভাইয়ের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের। মোস্তফা কামাল কি কারণে অফিস করছেন না। তার সমস্যা কোথায়। এসব অনুসন্ধান না করে তার চাকরী খাওয়ার বন্ধবস্ত পাকা করেছেন।
তিনি আরও জানান, পদস্ত কর্মতাদের অনৈতিক চাপে তার ভাই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরেন। একবার অফিসের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। এর পর থেকে অফিসে যাওয়া বন্ধ করেদেন। তবে তাকে উল্লেখ যোগ্য চিকিৎসা করাতে পারেনি বলে স্বীকার করেন। এ ছাড়া সে ওষুধও খায়ানো যায় না। ওষুধ ফেলে দেয়। বছর দুয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠিরা কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তার চিকিৎসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সে উদ্যোগ কিছু দূর এগিয়ে হুচোট খেয়েছে।
আমজাদ হোসেন বলেন, মায়ের মৃত্যুর পর মোস্তফা কামাল বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কৃষকের বিভিন্ন ফসল তছরুপ শুরু করেন। এমন ঘটনায় কয়েকদফায় জরিমানাও গুনেছেন। অনেক সময় অন্যের বাড়িতে ঢুকে পরে, মেয়ে মনুষরা ভয় পায়। এখন মানুষের সাথে খুবই খারপ আচরণ করেন। ফলে তাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। ঘরের মধ্যে প্র¯্রাব পায়খান ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু সেখানে না গিয়ে মেঝেতে প্রকৃতির ডাক সারেন। শীত মৌসূমে কাপড় পড়লেও খাওয়ার সময় সব কাপড় খুলে ফেলে।
তিনি আরও জানান, মোস্তফা কামালকে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিতে চায় না। যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় সেই বলেন “স্যার তো আমাদের ডাক্তার, তাকে কি চিকিৎসা দেব। এ ছাড়া তার পেনশনের ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকার ব্যাংকে তার নামে জমা রয়েছে। শুধু মাসিক টাকা তুলে খরচ করা হয়।
বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম জমির বলেন, সম্প্রতি দুই নির্বাচনের সময় তিনি ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন। মোস্তফা কামালের অবস্থা দেখে তারও হৃদয়ে দাগ কেটেছে। স্ত্রী সন্তান না থাকা ও নগদ টাকা সম্পত্তি নিয়ে ভাইদের মধ্যে কিছু বিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় তার চিকিৎসা ও সেবা দুই ব্যহত হচ্ছে।