এস. এম.আফতাব উদ্দিন
মুসলিম উম্মার ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ঈদ-উল আযহা অন্যতম। এই উৎসবের মধ্যে দুটি বিধান রয়েছে, একটি হলো হজ্ব অপরটি কোরবানি। আমরা এখানে কোরবানি বিয়ষটির আলোকপাত করতে চাই।
তবে ধর্ম বিষয়টি শিরোনামে থাকায় এ বিষয়ে দু-চার টি কথা আলোপাত না করলেই নই। মুসলিম জাতির জন্য ইসলাম কে ধর্ম হিসেবে মহান আল্লাহ রাব্বূল আলামিনই মনোনিত করেছেন। যার বিবরণ পবিত্র আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছে “নিসন্দেহে (মানুষের) জীবন বিধান হিসেবে আল্লাহ তায়ালার নিকট ইসলামই একমাত্র গ্রহনযোগ ব্যবস্থা “ (সুরা আল-ইমরানঃ আয়াত ১৯)
কোরবানি আরবি শব্দ, কুরবান অথবা আদ্বহা বা আযহা বা কুরবানী শব্দটির হিব্রু ভাষায় কারবান, আর সিরিয় ভাষার কুরবানা যার আরবি অনুবাদ “কারো নিকটবর্তী হওয়া” সাধারণ ভাষায় উৎসর্গ বলা হয়।
ইসলামি বিধান মতে কোরবানি হলো নির্দিষ্ট দিনে তথা ঈদ-উল আযহার দিনে এবং এর পরবর্তী তিন দিন তথা ১৩ই জিলহাজ্জ পযর্ন্ত নির্দিষ্ট ব্যক্তি বর্গের পক্ষ থেকে আল্লাহর সন্তোষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা। ইসলামের অন্যতম ইবাদত কোরবানি। মহান আল্লাহ আগের নবীদের জন্যও এই বিধান রেখেছিলেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি, সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা-হজ, আয়াত ঃ ৩৪)।
“অতএব আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় করুন এবং কোরবানি করুন” (সুরা-কাউসার, আয়াত ঃ ২)
কোরবানির ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হলো আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আদমের পুত্রদ্বয়ের (হাবিল-কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের (হাবিলের) কোরবানি কবুল হলো ও অন্যজনের কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবই। অন্যজন বলল, আল্লাহ খোদাভীরুদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সুরা-মায়েদা, আয়াত ঃ ২৭)।
কোরবানির ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্তু স্থাপন করেছেন ইবরাহিম (আঃ) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আঃ)। মহান আল্লাহর হুকুম পালনে ইবরাহিম (আঃ)-এর অতুলনীয় ত্যাগ ও ইসমাঈল (আঃ)-এর ধৈর্য আল্লাহর এতই পছন্দ হয়েছে যে তিনি তাঁদের ইতিহাস স্মরণীয় রাখার জন্য সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানির বিধান দিয়েছেন।
ইবরাহিম (আঃ) ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের কাছে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাই আসমানি এই তিন ধর্মে কোরবানির বিধান রয়েছে। সনাতন ধর্মেও পশু উৎসর্গের বিধান দেখা যায়। ফলে দেখা যায়, সব ধর্মেই নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ‘কোরবানি’র বিধান আছে। তবে দেশ ও ধর্মভেদে এর পৃথক নাম রয়েছে। সবাই এটাকে কোরবানি বলে না। বলা হয় ‘বলি’, ‘ঈশ্বরের জন্য রক্তোৎসর্গ’ ইত্যাদি। আরবিতে ‘উদহিয়্যাহ’ শব্দের অর্থ ‘রক্তোৎসর্গ’। তবে উর্দু ও ফারসি ভাষায় আরেকটি আরবি শব্দ ‘কোরবান’ থেকে ‘কোরবানি’ কথাটা প্রচলন হয়েছে।
সনাতন ধর্মের পশু উৎসর্গের বিধান ঃ হিন্দু ধর্মে জীব বলির কথা সর্বজন বিদিত। এখানে দেবীর উদ্দেশে জীববলি দেওয়া হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, ঈশ্বরের পদতলে পশুত্বকে বিসর্জন দেওয়া হয়। অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশ্বাস করেন যে মা স্বয়ং এই বলি গ্রহণ করেন।
এই উৎসবের সূত্রপাত নিয়ে হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। ধর্মাচার্য অধ্যাপক ডঃ বেদপ্রকাশ উপাধ্যায় লিখিত ‘হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ ও পুরাণে আল্লাহ ও হযরত মোহম্মদ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘আদিকালে ব্রহ্মার দুই পুত্র ছিল অথর্ব ও অঙ্গিরা। তিনি ঐশী প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হইয়া জ্যেষ্ঠ পুত্র অথর্বকে বলি দিতে উদ্যত হন। শাস্ত্রে উহা ‘পুরুষ মেধযজ্ঞ’ নামে খ্যাত। অদ্যাবধি নরবলির স্থলে পশুবলি দ্বারা উহা পালিত হইতেছে এবং বলি দেওয়ার সময় উক্ত পুরুষ মেধযজ্ঞের সূত্রগুলি পঠনের বিধান আছে।’’ (অথর্ববেদ দশম কান্ড, প্রথম অনুবাক দ্বিতীয় সুক্ত ২৬-৩৩ মন্ত্র)
ইহুদি ধর্মে পশু উৎসর্গ ঃ হুবহু মুসলমানদের মতো না হলেও ইহুদি ধর্মেও কয়েক ধরনের কোরবানি রয়েছে। যার মধ্যে পাঁচটি মৌলিক (পোড়ানো কোরবানি, শস্য কোরবানি, গুনাহের কোরবানি, যোগাযোগ কোরবানি, দোষের কোরবানি)। এ ছাড়া রয়েছে শাখা কোরবানি। সেগুলোর বিবরণ হলো “ঢালন কোরবানি মানে কোরবানি হিসেবে কোনো তরল পদার্থ কোরবানগাহের ওপর অথবা মাটিতে ঢেলে দিয়ে দেখানো হতো যে এটা আল্লাহর কাছে দেওয়া হলো”। ( লেবীয় ২৩ঃ১৩)।
দোরণ কোরবানি অন্য কোরবানির মতোই। তবে পার্থক্য হলো, ধর্মগুরু সাহেব কোরবানির জিনিস থেকে কিছু অংশ তুলে নিয়ে দুলিয়ে রাখতেন। (লেবীয় ৭ঃ৩১)। দোষ কোরবানি হলো কোরবানির জিনিস আনার আগে গুনাহের ক্ষতিপূরণ মূলক কোরবানি। (লেবীয় ৫ঃ১৬)। ধূপ কোরবানি হলো, আল্লাহর কাছে দেওয়া কতগুলো কোরবানির সঙ্গে ধূপ, যা কোরবানি করা হতো। (লেবীয় ১৬ঃ১২) গুনাহ কোরবানি হলো, গুনাহ থেকে পাকসাফ হওয়ার জন্য আল্লাহর উদ্দেশে নানা রকম পশু ও খাবার কোরবানি দেওয়া। এই কোরবানি একজন লোকের পক্ষে অথবা সমগ্র জাতির পক্ষে দেওয়া যেত। পোড়ানো কোরবানি হলো, কোরবানির বস্তুুর সম্পূর্ণটাই কোরবানগাহের ওপর পোড়ানো হতো। এ ছাড়া রয়েছে প্রথমে তোলা শস্যের কোরবানি, ফসল তোলার বা কাটার সময় প্রথম তোলা বা কাটা ফসল আল্লাহকে দেওয়া হতো। (লেবীয় ২ঃ১২-১৬)।
যোগাযোগ কোরবানি শুকরিয়া আদায় কিংবা মানত পূরণের জন্য দেওয়া হতো। আবার নিজের ইচ্ছায় করা কোরবানি হিসেবেও এটা করা যেত। শস্য কোরবানি হলো, শুকরিয়া জানানোর জন্য এবং আল্লাহর রহমত পাওয়ার জন্য লবণ দেওয়া খামিহীন পিঠা অথবা শস্য দিয়ে কোরবানি।
সকালবেলার কোরবানি ও সন্ধ্যাবেলার কোরবানি হলো একরকম পোড়ানো কোরবানি, যা প্রতিদিন দেওয়া হতো। (সূত্র ঃ কিতাবুল মোকাদ্দস, পৃষ্ঠা ৩৯০)।
খ্রিস্টধর্মে কোরবানি ঃ কিতাবুল মোকাদ্দাসে উল্লেখ রয়েছে যে, ইউসুফ ও মরিয়ম ঈসা মসিহের জন্মের সময় দুটি কবুতর কোরবানি করেছেন। সেই থেকে গ্রিসে পশু উৎসর্গ একটি কমন প্রথা। সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে একেশ্বরবাদী অর্থোডক্স চার্চে বকরি ও মুরগি দেওয়া একটি সুপ্রাচীন রীতি।
তবে কিছু জাতি-গোষ্টি আছেন যারা পশু কোরবানি কে জীব হত্যার সাথে তুলনা করে থাকেন। তাদের মধ্যে অন্যতম বৌদ্ধ ও ভেজিটারিয়ান সমাজের জনগোষ্টি।“প্রাণী হত্যা মহাপাপ, প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকুন” (প্রাণী-ত্রিপিটকের বাণী) ।
উপরোক্ত বক্তব্য ও তথ্য পর্যালোচনা করলে আমরা বলতে পারি কোরবানি ধর্মীয় বিধান দ্বারায় প্রতিয়মান। যাহা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় জাতি-গোষ্টির মাধ্যমে প্রতিপালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম মুসলিম জন সংখ্যা-অধ্যুষিত দেশ বাংলাদেশ যার ৮৮.২ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা বসবাস করেন। বাঁকী জনগোষ্টি হিন্দু, বৌদ্ধ ও খিষ্ট্রান (আদম শুমারী-২০১৬)। সংগত কারণে বাংলাদেশে কোরবানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। মুলত মুসলিম জনগোষ্টি একমাত্র সৃষ্টিকতার (আল্লাহ) সন্তোষ্টি লাভের আশায়ই কোরবানি করে থাকেন।
বিষয়টি যেহেতু অতিগুরুত্বপূর্ণ সেহেতু আমাদের ইসলামি বিধি-বিধান জেনে বুঝে পশু ক্রয়, যবেহ, বন্টন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। প্রয়োজনে বিধি-বিধান সম্পর্কে যাদের ভালো ধারনা আছে তাদের সহযোগিতা অবশ্যই প্রহন করতে হবে। বিশেষ করে করোনা মহামারী কালিন সময়ে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে। যেন আমরা করোনা ভাইরাস এ আক্রান্ত না হয় এবং অন্যকে আক্রান্ত না করি এ বিষয়ে আবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
সর্বপরি আমরা কোরবানি বা আত্মত্যাগের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহর) সন্তোষ্টি অর্জনের মধ্যে দিয়ে জাতিতে-জাতিতে, সমাজে-সমাজে, দেশে-দেশে হানা-হানী বন্ধ হয়ে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠবে এটাই আশাবাদ ব্যক্ত করি এবং আমাদের সমস্ত এবাদত আল্লাহর সমীপে অর্পিত হোক যেমনটি সৃষ্টিকর্তায় (আল্লাহ) পবিত্র আল-কোরআনে এরশাদ হয়েছে “নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সকল কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য” (সুরা আল আনাআম-১৬২)।