মাথা কেটে দিলে গাছের আর কিছু থাকে না – বন কর্মকর্তা
স্টাফ রিপোর্টার
বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন রক্ষণাবেক্ষণের ধুয়ো তুলে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি প্রতিদিনই হাজার হাজার গাছের শাখা প্রশাখা কেটে সাবার করছে। গাছের মাথা কেটে ফেলায় সরকারের সামাজিক বনায়ণ ও পরিবেশ হুমকীর মুখে পরছে। অনেক নতুন রাস্তায় বনায়ণ করা যাচ্ছে না।
পল্লী বিদ্যুৎ সূত্রে জানা গেছে, খোকসা উপজেলার ৯ ইউনিয়ন পৌর এলাকায় কুষ্টিয়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ২১,৭২৬ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন রয়েছে। এর মধ্যে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ১০০ কিলোমিটার লাইন চালুও রয়েছে। এসব লাইন গুলোর ৯০ শতাংশ গ্রামীন সড়কের পাশ দিয়ে টানা হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক বনায়নসহ অন্যান সরকারী প্রকল্পে উপজেলায় প্রায় পৌনে এক শো কিলোমিটার গ্রামীন সড়ক ও সেচ প্রকল্প এলাকায় বনায়ণ কর্মসূচি চালু রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের প্রধান খালের খোকসা অংশের হিজলাবট থেকে আজইল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ১২ কিলোমিটার রাস্তায় গতবছর থেকে কাঠ ও ফলদ গাছের দশ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে। চারা গাছ গুলো বেড়ে উঠেছে। এর মধ্যে পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারীরা লাইন পরিচর্যার নামে বেশ কয়েকটি গাছের মাথা কেটে রেখে গেছে। ফলে সুবিধা ভোগী প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সাধারণ মানুষ ও সরকার আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অন্যদিকে পরিবেশ হুমকীর মুখে পড়ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, খোকসা উপজেলা সদর – শোমসপুর রেল ষ্টেশন বাজার পর্যন্ত সাড়ে ৫ কিলোমিটার সড়ক। কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের এই সড়কের দুই পাশ এখনো ৫০ টিও বেশী শতবর্ষী ফলদ ও কাঠ জাতীয় গাছ রয়ে গেছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুতের লাইন টানায় বাবরার গাছ কেটে ছোট করায় কমপক্ষে ৭টি গাছ মারা গেছে। উপজেলা পরিষদের প্রবেশ দ্বারে কয়েক যুগের পুরাতন কৃষ্ণ চুড়ার গাছ দুটির একটি ইতোমধ্যেই মারা গেছে। অপরটি ধুকছে। একই কারণে গ্রামীন সড়কের পাশের অসখ্য শোভাবর্দ্ধনকারী গাছ মারা গেছে। মৃত্যুর প্রহর গুনছে তার সংখ্যাও কম না।
একই দৃশ্য মিলেছে খোকসা-একতারপুর, খোকসা-বনগ্রাম, শোমসপুর-কালীতলা, বিলজানি-শিমুলিয়া, শোমসপুর গোপগ্রাম, ধুসুন্ডা মোড়-শিমুলিয়া, ওসমানপুর কাজীর ব্রিজ-গনেষপুর সড়কসহ প্রায় ৪০টি সড়কে।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাশ্যপী বিকাশ চন্দ্র ফোন আলাপে বলেন, “খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন। আমারা রাস্তার সাইড দিয়ে বনায়ণ করি। দৃশ্যমান সুন্দর একটা দৃশ্য, তার উপর দিয়ে বিদ্যুতের লাইন নিয়ে যাচ্ছে। যখন আমাদের গাছ গুলো বিদ্যুতের তারের উপর উঠে যাচ্ছে, তখন আমাদের না জানিয়ে, আমাদের অনুপস্থিতিতেই তারা তাদের ইচ্ছা মত এই গুলির মাথা ও শাখা প্রশাখা কেটে দিচ্ছে। মাথা কেটে দিলে গাছের আর কিছু থাকবে না। এই জন্য এই বিষয়টি গত ডিডিসিতে( জেলা সমন্বয় সভা) পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার সাহেবকে আমি জানিয়েছি। আমাদের এরকম হচ্ছে।”
তিনি উল্লেখ করে বলেন, “কুমারখালী আমাদের যে খাল পাড় বনায়ণ আছে, ওখানেও দেখবেন মাথা কেটে এত সুন্দর বনায়ণ সব নষ্ট করে দিচ্ছে। তাদের উচিত হচ্ছে, এটা করার আগে আমাদেরকে জানানো। আমাদের এটা অংশী দারিত্বের বনায়ণ। এখানে আমাদের জনসাধারণের স্বার্থ জড়িত আছে। আমাদেরকে ইনফর্ম করে যদি তারা করে, আমি তাদের সে জন্য আহবান জানিয়েছি। ওরা বলছে ঠিক আছে। কিন্তু সাফাই কেটে নষ্ট করে দিচ্ছে। এখন যে নতুন রাস্তা গুলো বানাচ্ছে। সেই নতুন রাস্তায় সাথে সাথে পোল গুলো গেড়ে তার গুলো টেনে নিচ্ছে। যাতে আমরা বনায়ণ না করতে পারি।”
তিনি বলেন, “এখানে তো আমার রিজার্ভ ল্যান্ড নাই। রাস্তাতেই আমরা বনায়ণ করি। কিন্তু আমরা বনায়ন করতে পারছি না। ওদের সাথে সমন্বয়ের অভার রয়েছে। তারা আমাদেরকে কোন ভাবেই ইনফর্ম করেনা।”
লেখক আব্দুল মান্নান বলেন, “যখন পল্লী বিদ্যুতের লোকেরা গাছ কেটে সবুজায়ন ধ্বংস করছে তখন পরিবেশবিদরা কোথায় থাকেন।” পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ কাটা বন্ধ করা উচিৎ। তিনি মনে করেন পল্লী বিদ্যুতের লাইন তৈরীর সময় কোন পরিকল্পনা করা হয় না। ফলে সবুজায়ন ধ্বংস হচ্ছে।
পরিবেশবিদ গৌতম কুমার রায় বলেন, পরিবেশ ও মানব জাতির জন্য ক্ষতিকারক গ্যাসীয় উপাদান ধ্বংস করে অক্সিজেন তৈরীতে গাছের বিকল্প নেই। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ অপরিকল্পিত লাইন তৈরী করা বা রক্ষণাবেক্ষণের নামে অক্সিজেন উৎপাদকারী গাছের কান্ড কেটে পরিবেশের জন্য ক্ষতি করছে।
তিনি মনে করেন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন গুলো যদি প্লাষ্টিকের কাভার দেওয়া তার ব্যবহার করত তা হলে এত গাছ কাটার প্রয়োজন হত না।
কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার কুমারখালীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, গাছ কাটলে তার প্রভাব আবহারওয়ার উপর পরবেই। তবে পল্লী বিদ্যুত যে ভাবে শাখা প্রশাখা কাটছে তাতে কতটুকু প্রভাব পড়বে তা নিরুপণ দুরুহ। বিদ্যুতের দুর্ঘটনা এড়াতে সরকারী ভাবে তাদের গাছের শাখা প্রশাখা কাটার অনুমোদন থাকতে পারে।
পল্লী বিদ্যুতের সাব-জোনাল অফিসের দায়িত্বে থাকা এজিএম ইমদাদুল হক বলেন, অন্য সব বিদ্যুৎ সরবরাহ কারী প্রতিষ্ঠান গুলো কাজ করে শহর কেন্দ্রিক। তাদের লাইন গুলো সড়ক কেন্দ্রিক। সেখানে বছরে একবার গাছ কাটা হয়। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ কাজ করে গ্রাম পর্যায়ে। এখানে গ্রাহক চায় বিদ্যুত। তাই যে ভাবেই হোক লাইন তৈরী করতে হয়। গ্রামের গাছ গাছালি বেশী। তাই লাইন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায়ই গাছের ডাল পালা কাটা হয়।