২১ সালের একুশ ভাবনা

0
164
লেখক

প্রফেসর ডঃ মুন্সী মুর্তজা আলী

বাংলাদেশের বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটা বিরল ঘটনা হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। শুধু বাঙালি জাতির ইতিহাসে নয় জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি বর্তমান সমসাময়িক পৃথিবীর ইতিহাসেও বাংলা ভাষা এক অনন্য সাধারণ বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের মত সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা ও মায়ের ভাষা। ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া জাতি আমরা। এমন কোন দেশ নেই যারা ভাষার জীবন দিয়েছে। মানুষের জীবনের সাথে এবং ভাবের আদান প্রদানের সাথে ভাষা জড়িত। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে আজ অবধি প্রতিটি দেশের মানুষের অবিচল ভালবাসার নাম নিজ ভাষা।
প্রত্যেক জাতি ও গোষ্ঠী তার ভাষার কাছে ঋণী। তাই, শুধু একটি বিশেষ দিনে ভাষা শহীদদের স্মরণ করলেই কি ভাষাকে ভালবাসা হয় কিংবা ভাষা শহীদদের ঋণ পরিশোধ করা যায়? আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষা হলো মানুষের মনন ও সাধনার বিষয়। একে মনে মনে প্রানে লালন করতে হয়। কিন্তু আমরা ভুলে যায়। আমরা তা করি না। আমরা ভাষা নিয়ে গর্ববোধ করি। আমরা লালন করি না। অনেকেই হয়তো আমার কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। এবার সে ব্যাখায় আসি। আমরা ভাষাকে লালন করিনা বলেই, বিদেশী ভাষা নিয়ে বাড়াবাড়ি করি। ব্যক্তিক ও সমাজের উন্নয়নের জন্য যূগের সাথে তাল মিলিয়ে অবশ্যই বিদেশী ভাষা শিখতে হবে। কিন্তু নিজ ভাষাকে ছোট করে নয়। বাঙালি হয়ে যখন অন্য ভাষায় আমরা বিয়ের কার্ড ছাপায়, এটা বাংলা ভাষার প্রতি ও ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি অসম্মান।
একুশের প্রভাত ফেরিতে অংশ নেবার জন্য আমরা প্রতিযোগিতা শুরু করি। কিন্তু সারা বছর ভাষাকে চর্চা করি না। আমরা আমাদের সন্তানদের বিদেশী ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষা শেখায় না। বাংলাদেশে অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে। কিন্তু সেখানে বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কোন উদ্যোগ নেই। যেসব বাঙালি বিদেশে বসবাস করেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখাতে কোন আগ্রহ দেখান না। তাদের অনেকে আবার গর্ব করে বলেন, আমার বাচ্চা বাংলা জানে না। আমার তো মনে হয়, এত ঐসব বাবা মা’দের লজ্জা করা উচিত। কিন্তু তারা লজ্জিত হন না। একবার ভাবুন তো, আমাদের বাঙ্গালিদের মানসিকতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? যেটা নিয়ে গর্ব করা দরকার, সেটা নিয়ে আমরা গর্ব করিনা। আর যেটা নিয়ে লজ্জা পাওয়া দরকার, সেটা নিয়ে আমরা লজ্জা পাইনা। এদিক দিয়ে বিচার করলে বাঙালি জাতি একটি অদ্ভুত জাতি বলে প্রতীয়মান হয়। ইদানিং বাংলাদেশে বসবাসকারী কিছু মানুষদের মধ্যে একটা ধারা চালু হয়েছে। সেটা হলো, কথার মাঝখানে ইংরেজী বলা। এটা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। এদের মধ্যে অনেকে এমনভাবে ইংরেজি বলে, সেটা না হয় বাংলা না হয় ইংরেজি। আগডুম বাগডুমের মত যেটাকে বাংরেজি বলা যায়। যারা কথার মাঝে ইংরেজী বলে; অনেকে তাদের কথা শুনে আবার ভাবে, “ওরে বাব্বা, লোকটা কত বড়ই না শিক্ষিত। কথায় কথায় ইংরেজি বলে”। নিজ ভাষাকে ছোট করে কেউ প্রকৃত বড় হতে পারে না। নিজ ভাষাকে অবজ্ঞা করলেই স্মার্ট হওয়া যায় না এবং স্ট্যাটাসও বাড়ে না। যারা এসব মনে করে, তাদের মনের শক্তি কম বলেই মনে হয়।

একবার নিউ ইয়র্কে এক বাঙালি ভদ্রলোকের (?) সাথে পরিচয় হলো। উনি এক জার্মান মহিলাকে বিয়ে করেছেন। এটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু কথা প্রসঙ্গে যখন বললেন, উনি উনার সন্তানদের জার্মান ভাষা শেখানোর জন্য স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করেছেন। এতেও আমার কোন মাথা ব্যথা হলো না। মাথা ব্যথা তখনই হলো, যখন উনাকে প্রশ্ন করলাম, উনি উনার সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখাচ্ছেন কি না? উনি আমার প্রশ্ন শুনে যেন বিরক্তই হয়েছিলেন বলে উনার নীরবতা ও মুখভঙ্গি দেখে আমার সে রকমটিই মনে হয়েছিল। অথচ আমি এখানে অনেক বিদেশী বাবা মা’দের দেখেছি, তারা শুধু তাদের সন্তানদের তাদের মাতৃভাষায় কথা বলায় শেখান না, এমনকি তারা তাদের সন্তানদের হাতে কলমে তাদের নিজ দেশের ভাষা শেখান। ভাষার প্রতি তো মানুষের এরকম আকর্ষণ থাকা উচিত। বিদেশে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের সন্তান যদি বাংলা ভাষা বলতে ও লিখতে পারদর্শী হয়, এতে মনে হয় তাদের পিতামাতাদেরই মঙ্গল। কেননা, কোন বাঙালি বাবা মা’দের তাদের নিজ দেশে কোন সমস্যা হলে ভবিষ্যতে তাদের সন্তানেরা তাদের পাশে যেয়ে দাড়াতে পারবে বলে আমি আশাবাদী। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। আমাদের বাঙ্গালীদের কেউ কেউ বাচ্চাদের হিন্দি সিনেমা দেখাতে অভ্যস্ত করে তুলি। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করি। আমেরিকাতে দেখেছি, অনেক ভারতীয় আমাদের সাথে কথা বলার সময় হিন্দি ভাষায় কথা বলা শুরু করে। অনেক ভারতীয় ব্যক্তিই আমার সাথেও হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে। আমি তখন ভদ্রভাবে ইংরেজীতে বলে দিয়েছি। আমি হিন্দি জানিনা। অনেক ভারতীয়রা আমার কথা শুনে বিস্মিত হয়েছে যে, আমি হিন্দি জানিনা? আমি তখন তাদের পাল্টা প্রশ্ন করেছি, তারা বাংলা জানে কি না? তারা বলেছে, না তারা বাংলা জানে না। আমি তখন তাদের বিনয়ের সাথে বলেছি, তোমরা যদি বাংলা না জান, তাহলে আমি কি করে হিন্দি জানি? পাঠক, আমার কথা আপনারা যেভাবেই নিন না কেন, আমি কিন্তু এই জায়গায় কঠিন। হিন্দি কোন আন্তর্জাতিক ভাষা নয় যে, একজন ভারতীয়র সাথে আমাকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে হবে? তবে আমি হিন্দি ভাষাকে ছোট করার জন্য লিখাটির অবতারনা করিনি। কথাটি এজন্য লিখা, এটা আমার মাতৃভাষার প্রতি ভালবাসা। মনে হতে পারে, এত ভাষা থাকতে হিন্দি ভাষার উদাহরণ দিলাম কেন? এর উত্তর হলো, পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতের অনেকেই মনে করে, বাংলাদেশের সকল মানুষ হিন্দি জানে। তাদের ভিতর এই ধারনা জন্ম নেবার জন্য আমাদের বাংলাদেশের মানুষই দায়ী। কেননা, অনেক বাংলাদেশীরাই ভারতীয়দের সাথে কথা বলার সময় হিন্দিতে কথা বলে। এটা কি গুণ না দোষের- সেটা পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, অন্য ভাষা শেখাতে দোষ নেই। ভাবের আদান প্রদান করতে হলে আন্তর্জাতিক ভাষা (ইংরেজি) ছাড়া অন্য ভাষায় কথোপকথন না করায় উত্তম। আমার মনে হয় এটায় জাতীয়তাবোধ এবং ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ। একজন মানুষ পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, যে ভাষায় সে জীবিকা ও জ্ঞান অর্জন করুক না কেন, নিজ ভাষার প্রতি তার অসীম ভালবাসা লালন করা একান্ত কাম্য।

প্রফেসর ডঃ মুন্সী মুর্তজা আলী, লোক প্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।