স্টাফ রিপোর্টার
কুষ্টিয়ার খোকসার তিনটি ইউনিয়নে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তে রোগীর সংখ্যা আশঙ্কা জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে শিশু থেকে মধ্যবয়সীর সংখ্যাই বেশী। তিন মাসে উপজেলার তিন শতাধিক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হলে শীত আসা পর্যন্ত প্রচুর মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ আশক্সক্ষা করছে।
জুলাই মাসের শুরুর দিকে উপজেলার জানিপুর, শিমুলিয়া ও গোপগ্রাম ইউনিয়নে ব্যপক হারে ডেঙ্গু জ্বর সাথে পেটের ব্যথায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ শতাধিক ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করছে স্থানীয় স্বাস্থ্য প্রশাসন। ইতোমধ্যে স্বজল নামের এক যুবক ডেঙ্গুতে মারা গেছে বলে পরিবার দাবি করছে। ডেঙ্গু উপদূর্ত এসব ইউনিয়নের গ্রাম গুলোতে প্রতিকার বা জনসচেতনা মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে একাধিক জনপ্রতিনিধি দাবি করেন।
স্থানীয় ডায়াগনষ্টিক সেন্টার গুলো সূত্রে জানা গেছে, জানিপুর ইউনিয়নের একতার পুর, ঈশ্বরদী ও খাগড় বাড়িয়া গ্রামে প্রায় ৫০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। গত এক সপ্তাহে এসব গ্রাম থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে আসা স্মৃতি, শিমুল, জাকারিয়া, সুনতা, পল্লবী, কামনা ও ইন্দ্রজিতসহ ১৫ জন শিক্ষার্থী শরীরে ডেঙ্গু সনাক্ত হয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসখ্যান বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, জুলাই মাসে ১২ তারিখ থেকে সেপ্টেস্বরের ৩০ তারিখ সকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের উপসের্গ নিয়ে ভর্তি রোগীর মধ্যে ১০২ জনের শরীরে ডেঙ্গু সনাক্ত হয়। আক্রান্তদের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিন শিশু রয়েছেন। এ ছাড়া ছাত্রসহ পূর্ন বয়সী ৬৪ জন পুরুষ এবং স্কুল ছাত্রী ও গৃহীনিসহ ৩৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তারা সবাই নিজ নিজ গ্রামে বসবাস করেন।
সূত্রটি আরো জানায়, উপজেলা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তিন শতাধিক ছাড়িয়েছে বলে তারা মনে করা হচ্ছে। ডেঙ্গু পজেটিভ অধিকাংশ রোগী নিজের বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্তদের মধ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ পড়–য়াদের সংখ্যা বেশী। কৃষি শ্রমিক ও গৃহীনি আক্রান্ত হয়েছে ৪৫ শতাংশ। শনিবার দুপুরে এ রিপোর্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বর সনাক্ত ১১ জন রোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলেন। এরোগীদের মধ্যে শেষ ২৪ ঘন্টা শুক্রবার দুপুর থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়। বাঁকীদের বেশীর ভাগ সুস্থ্য হয়েছে বাড়ি ফিরে গেছেন। অনেকেই রেফার্ড নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য জেলা সদরের হাসপাতাল বা কিনিকে চিকিৎসা চলে গেছেন।
জানিপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের একতার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। জ্বরের সাথে পেটের ব্যাথা নিয়ে ৫ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। জ্বরসহ অন্য উপসর্গ নেই তাই বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। পড়া মনে রাখতে পারছে না। মায়ের কাঁধে ভর করে চলা ফেরা করছে।
শিশুটির মা কবিতা খাতুনের কথায় ফুটে ওঠে উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা সংকটের কথা। মেয়ের বমি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন কুষ্টিয়া জেলা সদর থেকে রক্ত পরীক্ষা করানো লেগেছে। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগীদের সাধারণ রোগীদের সাথে ডেঙ্গু আক্রান্তদের রাখাসহ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নানা অনিয়মের কথা।
এ ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দার বিরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। তিনি শিমুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। গত সোমবারে তার জ্বর আসে। কিন্তু পরীক্ষা করান বুধবারে। সেদিনই ধরা পরে তার ডেঙ্গু পজেটিভ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন চিকিৎকের পরামশ্যে তিনি বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জ্বর পেটের ব্যাথা সাথে শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া স্বজলের ছবি বুকে করে বাড়ির প্রবেশ পথের পাশে ঘরের দাওয়ায় অপেক্ষা করেন মা বুলবুলি রানী। বাবা মার বড় ছেলে মার যাওয়ার পর পরিবারেটির এক মাত্র আয়ের উৎস ছিল স্বজল। বাড়ির পাশের শিমুলিয়া তহবাজারে তার সেলুনের দোকান ছিল।
সে উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সঞ্জিব বিশ্বাসের ছেলে। গত দুই সপ্তহ আগে এক সকালে সে প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়। দ্বিতীয় দিন জ্বর ছেড়ে যায়। শুরু হয় পেটের ব্যথা। গ্রামের এক ডাক্তারকে ডাকা হয়। জ্বর পরবর্তি পেটের ব্যাথায় আক্রান্ত ওই যুবকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অবস্থার দ্রæত অবনতি ঘটলে সেই রাতেই তাকে (স্বজল) কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ভর্তির পর ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষা নিরিক্ষা করতে দেওয়া হয়। কিন্তু সে রিপোর্ট হাতে আসার আগেই যুবক মৃত্যুর কাছে হারমানে।
নিহত স্বজলের বাবা সঞ্জিত বিশ্বাস ছেলের শোকে নির্বাক হয়ে গেছেন। মা বুলবুলি রানী পরিপাটি হয়ে ছেলের এক খানা ছবি বুকে নিয়ে পথের ধারে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে ছেলের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কেউ কিছু জানতে চাইলে শুধুই কাঁদেন।
জ্বর পরবর্তী পেটের পিড়া আর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে ছেলেকে হাসপাতালে নেন সঞ্জিব বিশ্বাস। রাতে তরিঘড়ি করে রেফার্ড করা হয়। সকালে কুষ্টিয়া নিয়ে ভর্তি করা হয়। রিপোর্ট করতে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু রিপোর্ট আসার আগার আগে তিনি একমাত্র ছেলেকে হারান। তার ধারণা ছেলে হয়তো ডেঙ্গুতে মারা গেছে।
জানিপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর মজনু মন্ডল জানান, তার একলাকায় প্রতিটি বাড়িতেই এক দুইজন করে জ্বর আক্রান্ত রোগী রয়েছে। পরীক্ষা করা হলে দেখা যাবে তাদের বেশীর ভাগ ডেঙ্গু আক্রান্ত। গ্রামের ডোবা ও খাল গুলোতে পাট পচন দেওয়ায় প্রচুর মশা হয়েছে। এসব ডোবায় এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু এসব ইউনিয়ন পরিষদ বা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
জানিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মজিদের সাথে মুঠো ফোনে কথা বলা হয়। তিনি যেন ডেঙ্গুর নাম এই প্রথম শুনলেন। তার ইউনিয়নে ডেঙ্গু আক্রান্তদের সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারেন নাই।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে কর্তবত চিকিৎসক আবির হোসেন সোহাগ বলেন, গত তিন মাস আগে ডেঙ্গুর বিস্তার শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা বিশেষ কয়েকটি ইউনিয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে উপজেলায় ডেঙ্গুর প্রকপ চরম মাত্রায় পৌঁচ্ছে। নিয়ন্ত্রন করা না গেলে ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারন করতে পারে।
উপজেরা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কামরুজ্জামান সোহেল ডেঙ্গু বিস্তারে সংকীত। ডেঙ্গু নির্নয় হলেই সে রোগী কে যথেষ্ট চিকিৎসা দিয়ে স্বুস্থ্য করা সম্ভব। এখন হাসপাতালে আসার জ্বরের রোগীরদের ৫০ শতাংশের শরীরে ডেঙ্গু পজেটিভ ধরা পরছে। তিনি মনে মানুষের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধি পরামর্শ দেওয়ার জন্য মাসিক সমন্বয় সভায় প্রথম তুলেছিলেন। আলোচনা হয়েছে। কতটুকু কাজে আসছে বুঝতে পারছেন না। তার কাছে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার কোন তথ্য নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপন বিশ্বাস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের মাধ্যেমে জন সচেনতা বৃদ্ধিতে নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহন করা বিষয়ে নিশ্চিত করেন। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু পরীক্ষার ৫০ টি কিট আনার হয়েছে বলে দাবিও করেন। মাশাদের জন্ম স্থান নির্মূলে জনগনকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া ডেঙ্গুতে কেউ মারা গেছেন বলে তিনি শোনেন নাই।