মাইক্রোবাস কেড়ে নিলো দুই সহদরসহ চার শিশুর প্রাণ

0
75

স্টাফ রিপোর্টার

কোরআন পড়ে মক্তব থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাইক্রোবাস চাপায় নিহত দুুুই মেয়ে নুসরাত ইসলাম মারিয়া ও তানজিলার শোকে হতবিহল হয়ে পরেছেন বাবা পাালন মিয়া ও নাজমা খাতুন দম্পতি। একই দুঘটনায় নিহত চার স্কুল ছাত্রীর বাড়ি ও গ্রাম জুড়ে শোকের মাতম চলছে। গ্রামে কবর স্থানে পাশা-পাশি কবরে দাফন করা হলো তিন পরিবারে চার কন্যা শিশুকে।

মধ্যবিত্ত এই কৃষক পিতার স্বপ্ন ছিল মেয়েরা লেখা পড়া শিখে বড় কিছু হবে। তাই জেনারেল শিক্ষার পাশা-পাশি ধর্মীয় শিক্ষার জন্য বাড়ির পাাশের মসজিদের মক্তবে দিয়ে ছিলেন। কিন্তু সব স্বúœই সড়কে পিষে গেছে। এখন আর কোন প্রত্যাশা নেই দুই মেয়ে হারা পালন মিয়ার। ছোট মেয়ে তানজিলা আগেই কোরআন ধরেছিল। আজ (রবিবার) বড় মেয়ে মারিয়া কোরআন ধরেছে। এ জন্য তিনি দুই কেজি বাতাসা (মিষ্টি) দিয়ে সকালে মক্তবে পাঠিয়ে ছিলেন তাদের। কিন্তু মেয়েরা বাড়ি ফিরলো লাশ হয়ে।

রবিবার সকাল তখন সাাড়ে ৬ টা। কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের খোকসার শিমুলিয়া কুঠিপাড়া গ্রামের মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটে। কুষ্টিয়া গামী ঘাতক মাইক্রোবাসের নিচে চাপা পরে ৫ মেয়ে শিক্ষার্থী। চালক পালিয়ে যায়। আটকা পরা মাইক্রো বাসের যাত্রী ও শিশুদের উদ্ধার করে স্থানীয়রা। শিক্ষার্থীদের উদ্ধারের সময় গাড়িটি সড়কের পাশের একটি পুকুরে পরে যায়।

পাালন মিয়া ও নাজমা খাতুন দম্পতিার তিন সন্তানের মধ্যে মারিয়া ও তানজিলা ছিল বড়। ছোট ও একমাত্র ছেলে আশরাফ। সেও বোনদের মারা যাওয়ায় ভেঙ্গে পরেছে। তাকে ঘিরেই পরিবারের লোকরা মাতম করছেন।

মিম নামের ৫ম শ্রেণি ছাত্রীকে ঘটনা স্থল থেকে মৃত অবস্থা উদ্ধার করা হয়। সপ্তম শ্রেনির ছাত্রী তানজিলা খতুন ও নুসরাত ইসলাম মারিয়া মারা যায খোকসা ও কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নেবার পথে। তারা আপন দুই বোন। শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যায়ে সপ্তম শ্রেনির ছাত্র ছিল। এ ঘটনায় নিহত মিম তাদের আপন চাচাত বোন। সে পড়ত গ্রামের পূর্বাসা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেনিতে। অপর নিহত জুুথি একই স্কুলের একই শ্রেনির ছাত্রী ছিল। এ ঘটনায় অপর আহত ফাতেমাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেও একই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। তাদের সবার বাড়ি শিমুলিয়া কুঠিপাড়ায়। বাড়িও পাশা-পাশি।

আরও পড়ুন –শেখ হাসিনার জন্মদিন পালন করতে আসা ছাত্রলীগ পালালো

দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা সড়কে বাঁশ দিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে দুর্ঘটনা রোধে ¯েøাগান দিতে থাকে। এ সময় সড়কের দুই কিলোমিটার জুড়ে যাত্রবাহী বাস ও ট্রাক দাঁড়িয়ে যায়। ফলে সাধারণ যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হয়। চার ঘন্টা পর বেলা ১১ টার দিকে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যস্তায় অবরোধ তুলে নেয় গ্রামবাসী।

নিহত শিশুদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পরলে শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও পূর্বাসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় একদিনের ছুটি ঘোষনা করা হয়। নিহতদের পরিবারের পাশে সমবেদনা জানাতে হাজার নারী পুরষের ঢল নামে। একসাথে এতো লাশ দেখেনি গ্রামের মানুষ।

দুপুর পৌনে ১টায় তিন ছাত্রী লাশ বাহী আ্যাম্বুলেন্স বাড়ির সামনের সড়কে আসার পর স্বজনহারাদের আহজারি নতুন মাত্রা পায়। নিহতের স্কুলে শিক্ষক সহপাঠি, প্রতিবেশী আত্মীয়দের আত্মনাদে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। পরে বিকালে শিমুলিয়া কুঠিপাড়া ঈদগাহ মাঠে চার কোরআন শিক্ষার্থীর নামাজে যানাজার করা হয়। এরপরে স্থানীয় কবর স্থানে পাশাপাশি তাদের দাফন করা হয়।

কুঠিপাড়াা মসজিদের ইমাম ও মক্তবের একমাত্র শিক্ষক আব্দুল হক জানান, সকাল সাড়ে ৬ টায় মক্তবের প্রায় ১৩ জন ছাত্র-ছাত্রীকে ছুটি দেওয়া হয়। তিনি মসজিদের ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ পেয়ে তিনি বেড়িয়ে আসেন। এসেই নিজের ছাত্রীকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।

স্থানীয়রা জানান, মক্তবের শিশুরা সড়কের ডান পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় ঢাকা থেকে আসা কুষ্টিয়া গামী মাইক্রোবাসটির চালক উল্টো দিকে ঢুকে শিশুদের চাপা দেয়। পাঁচ শিশুই মাইক্রো বাসের নিচে চাপা পরে। ঘটনা স্থলেই একশিশু মারা যায়। পরবর্তিতে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায় আরও তিনজন।

একসাথে দুই কন্যা হারা নাজমা খতুনকে ঘিরে আছেন কয়েক’শ প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজন। তিনি শুধু মেয়েদের কথা বলে বিলাপ করছেন। পাশেই নিহতের দাদি বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। তাকে সুস্থ্য করতে চেষ্টা করছেন প্রতিবেশীরা। একটু দূরেই নিহতদের বাবা পালন বসে শুুধু ঘামছেন। তিনিও শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন।

কয়েকে দফা চেষ্টার পর ছোট করে বললেন, কার কাছে আর অভিযোগ দেব। আমার যা হবার হয়ে গেছে। আমার আর কি করার আছে। আশা ছিল মেয়েদের লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করার। মেয়েরা নিজের ইচ্ছাতেই কোরআন পড়তে যেত। আজ বড় মেয়ে কোনআন ধরবে বলে আগের রাতেই তিনি মিষ্টি কিনে এনে রেখেছিলেন। সকালে তিনি নিজেই মেয়েদের ডেকে আগের রাতে আনা মিষ্টি দিয়ে মক্তবে পাঠিয়ে ছিলেন। সব নিভে গেলো।

শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুজ্জামান জানান, ছাত্রী হিসাবে নিহত দুই বোন বেশ ভালো ছিল। পড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল। বাবা গরিব মানুষ হলেও মেয়েদের লেখা পড়ার ব্যাপারে তার চেষ্টা ছিল।

সপ্তম শ্রেণির ছাত্র খাদিজা সহপাঠিদের মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। সে ঘাতক ড্রাইারের বিচার দাবি করে।

নিহতদের প্রতিবেশী তোরাব আলী। ১০ বছর ধরে কবর কাটছেন। কিন্তু একসাথে এতো কবর কাটেননি। তিনি এতো শিশুর মৃত্যু এক সাথে দেখেন নি।

কুষ্টিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশ ওসি আকুল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, এঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। পরিবার যদি মামলা করে তিনি নেবেন। আর তা না হলে পুলিশ বাদি মামলা হবে। ঘাতক চালককে আটকে পুলিশের একাধিক দল অভিযান চালাছে।