স্টাফ রিপোর্টার
জোর করে বাল্য বিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে থানায় যাওয়া সাহসী ছাত্রী মিনু খাতুন লোক লজ্জার ভয়ে নানার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কাসের বই পড়ে সে শিখেছে বিপদে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল। তার মত নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতেই সে উচ্চ শিক্ষা নিতে চায়।
খোকসার শোমসপুর ইউনিয়নের বুজরুখ মির্জাপুর গ্রামের নবম শ্রেণির মিনু খাতুনকে বুধবার বাড়ি থেকে জোরজুলুম করে নিয়ে গিয়ে বাল্য বিয়েতে বাধ্য করা হয়। এ বিয়েতে সে (মিনু) কালমা পড়েনি। কোবুল বলেনি। কোন কাবিন হয়নি। কাজী ও ছিল না। ঘটক নিজে কথিত এ বিয়ে পড়িয়েছে।
ইট ভাটার শ্রমিক সোহেল হোসেন মোল্লা ও নাজমা খাতুন দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে মিনু বড়। যে বাবা তার মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। সেই বাবার বাড়িতে টিন আর পাট কাটির তৈরী খুপড়ী ঘরে বসবাস করেন তিনি। বড় মেয়ে মিনু বিলাজানি দাখিল মাদ্রাসায় নবম শ্রেণির মানবিক শাখায় পড়ে।
এই কথিত বিয়ের ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে গ্রামের মহিলারা ভিড় করছে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন কথা বলছে। অবশেষে বাধ্য হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে মিনুকে তার নানা বাড়ি মালিগ্রামে পাঠানো হয়েছে।
মালিগ্রামে নানাবাড়িতে আশ্রয়ে থাকা মিনু জানায়, বুধবার তার বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা ছিল। রাতে তারই প্রস্তুতি নিয়েছে। সকালে তার ঘুম ভাঙ্গে তারই বিয়ে নিয়ে দাদা আর মায়ের মধ্যে তুমুল ঝড়গা শুনে। এ সবের মধ্যে সে পরীক্ষার দিতে মাদ্রাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেল। এ সময় তাদের খুপরি ঘরের দরজায় এসে বাঁধাদেন দাদা। হাতে ঘাস কাটা কাঁচি। ঘর থেকে নামলেই তার পা দু’খানা কেটে ফেলবেন বলে হুমকী দিচ্ছিলেন। এ সময় তার মা আত্মহত্যা করবে বলে বিলাপ করছেন। তার বাবা সোহেল সেদিন ইটের গাড়ির সাথে ঢাকায় ছিলো। পরণের আটপৌরে পোশাকেই সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তাকে টেনে হিচরে ঘর থেকে বেড় করে নিয়ে যায় দাদা দাদি। সে জানেনা কোথায় যাচ্ছে? আর বিয়েই হবে কার সাথে? পথে গিয়ে ঘটকের পরামশ্যে তাকে কুমারখালীর ঘাসখাল গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার কথিত বিয়ে দেওয়া হয়।
বাল্য বিয়ে ২ ঘন্টা পরই ছাত্রী মিনুকে নিজের বাবার বাড়ি খোকসার গ্রামে ফিরিয়ে আনেন দাদা দাদি। বর নূর হোসেন ও ঘটক রমজান আলী শেখ সাথে আসেন। এই সুযোগ হাত ছাড়া করেনি মিনু। নিজের বুদ্ধিমত সন্ধ্যার আঁধার নামার আগেই সাথী নামের এক মামীসহ থানার বড় দারোগার কাছে গিয়ে হাজির হয়। জোরজুলুম করে বাল্য বিয়েতে বাধ্য করার বিষয় খুলে বলে।
আইনী সহয়তা এগিয়ে আসে স্থানীয় প্রশাসন। কথিত বর নূর হোসেন ও ঘটককে বাল্য বিয়ে নিরোধ আইনে কারাদন্ড দেয়। কিন্তু এখন লোক লজ্জার ভয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে পাশের মালিগ্রাম মধ্যপাড়ায় নানা আজম আলী ওরফে আজোর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। মাদ্রাসায় যাওয়া তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া কথিত বর যদি এসে স্ত্রী হিসেবে দাবি করে এ নিয়ে নানা দুশ্চিন্তায় রয়েছে পরিবারটি।
পাঁচ জনের সংসার দিনমুজুর বাবার কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়ে। এ জেনেও সে লেখা পড়া করতে চায়। কথিত বিয়ে তার জীবনের একটি কলঙ্কিত অধ্যায় বলে সে মনে করে। নিজের পায়ে দাঁড়ানো ও তার মত নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতে লেখা পড়ার বিকল্প নাই বলে সে মনে করে।
মাদ্রাসা ছাত্রীর সহযোগীতায় এগিয়ে আসা সাথী খাতুন বলেন, মিনুর বাবা মা মেয়েকে পড়াতে চান। কিন্তু দাদা দাদি এসব করেছে। শিশুদের জীবন নিয়ে সিনিমিনি খেলার সাথে জড়িতদের বিচার দাবি করেন তিনি।
ছাত্রীর নানী সকিনা খাতুন বলেন, ছোট বেলা থেকে মিনুর পড়া লেখার মাথা ভালো। তাইতো সবাই চেষ্টা করে মেয়েটাকে পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ওর দাদার মাথায় কি ঢুকেছে তা তিনি বুঝছেন না। এবার আর নাতিনকে তিনি ছাড়ছেন না। নিজের কাছে রেখে পড়া লেখা করাবেন।
ছাত্রী মা নাজমা খাতুন জানান, কখন ব্যাটারা (বর পক্ষ) এসে তার মেয়েকে আবার বউ বলে দাবি করে। এ নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় আছেন। এ ছাড়া পাড়ার বউ-ঝিড়া নানা কথা বলছে। তাই মেয়েকে নানা বাড়ি পাঠানো হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিপেন কুমার বিশ্বাস জানান, ছাত্রীটি পড়া লেখা করতে চাইলে তিনি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সহায়তা করবেন। কোন সুযোগ আসলে এই দড়িদ্র পরিবারটির সহায়তা দেওয়া হবে।