খোকসায় স্মার্ট প্রতারণা শিকার

0
294
এভাবেই অন্যের বারান্দায় কাপড় টাঙিয়ে বাস করছেন রমজান আলী।

শতাধিক দুস্থ পরিবার বাসস্থান হারা

স্টাফ রিপোর্টার

কুষ্টিয়ার খোকসার স্মার্ট প্রতারণার শিকার শতাধিক দুস্থ পরিবারের ঘর নির্মান কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাসস্থান হারিয়ে প্রতিবেশীদের ঘরে আশ্রয় নেওয়া দুস্থ পরিবার গুলো মানবেতর জীবন যাপণ করছে।

রমজান আলীর ঘর ভেঙে অসম্পন্ন নতুন ঘর।

গড়াই ও সিরাজপুর হাওড় নদী বেষ্টিত বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন। মোট জনসংখ্যা ১৫ হাজারের মত। নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় উন্নয়নে দূত হিসেবে সম্প্রতি হাজির হন প্রতারক চক্রের প্রধান রুবেল আহম্মেদ। নিজেকে একটি সাহার্য সংস্থার বাংলাদেশের কান্টি ডিরেক্টর পরিচয় দেন। হেলিকপ্টরে চলা ফেরা করেন এই স্মাট প্রতারক। বিদেশীদের অর্থায়নে বহুমুখি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামের দুস্থদের আধাপাকা টিনসেড ঘরতুলে দেওয়া কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু মাঝ পথে এসে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বরদের অধিক লাভ জনক প্রকল্প পাওয়ে দেওয়ার কথা বলে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিনিয়ে সটকে পরে প্রতারক চক্রের প্রধান। দুস্থদের পাকা ঘর নির্মান প্রকল্প বন্ধ করেদেন সংশ্লিষ্ট এলাকার মেম্বররা। আর বাসস্থান হারা দুস্থরা পরেন বিপাকে। এই শীতের মধ্যে প্রতিবেশীর ঘরের বারান্দায় আবার কেউ প্রতিবেশীর রান্না ঘরে কাপড় টাঙিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

শুন্য ভিটেয় ছকিরন নেছা।

ভুক্তভোগী একাধিক মেম্বর জানান, তিন মাস আগে এই রুবেল আহম্মেদ কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ইন্টারন্যাশল কো-অপারেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের কান্টি ডিরেক্টর পরিচয় দিয়ে এক দালালের মাধ্যমে আসেন। বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন হেলিকপ্টর। বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাবুল আখতার সহ পরিষদের মেম্বরদের সাথে একাধিক বৈঠক করেন। হাতে নেওয়া হয় বনগ্রামে তিনটি ইংলিশ মিডিএম স্কুল, রিসোট, আবাসন ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থদের উন্নয়নে হরেক রকম প্রকল্প। বসবাস শুরু করেন ইউনিয়ন পরিষদের ভবনে। নিয়োগ দেন দুই রাধুনীসহ প্রায় ৮ জন কর্মচারী।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থদের উন্নয়নে ওয়ার্ডের মেম্বদের মাধ্যমে চাঁদট গ্রামে গড়াই নদীর ভাঙ্গনরোধে জিও ব্যাগ ফেলা হয়। একই সময়ে ৭, ৮, ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ১২০টি অসহায় দুস্থদের গৃহনির্মান প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন ঘর নির্মানের ধুয়োতুলে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রুস্তম, ছকিরন নেছা, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুলভ, মজিদ, তমেজ, ছাইদুল, ওহাব, আতিয়ার, বুরো, আপিল, শাহিনের মত শতাধিক দুস্থ পরিবারের মাথা গোজার শেষ আশ্রয় বসত ঘর ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে এসব পরিবারের জন্য ১৫ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া দুই কক্ষের থাকার ঘর সাথে রান্নর ঘর ও পাকা টয়লে নির্মান কাজ শুরু করা হয়।

বনগ্রাম পূর্বপাড়ায় বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল আখতারের নামে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য চড়া দামে জমি বাইনা করা হয়। ইতোমধ্যে এই প্রতারক চক্র আরো দুইশো কোটি টাকার লাভজনক প্রকল্প পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বর ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে একাধিক মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে ভুক্তভোগী জনপ্রতিনিধিরা জানান।

ভ্যান চালক শাহিনের ঘর ভেঙে নির্মান করা হচ্ছি প্রকল্পের ঘর।

বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরের বনগ্রামে সরেজমিন গিয়ে কথাবলা হয় বাসস্থান হারা বৃদ্ধ রমজান আলীর সাথে। পাঁচ সন্তানের জনক বৃদ্ধের বসত ঘর ভেঙ্গে সেখানে আধাপাকা ঘর তৈরী শুরু করেছিল স্থানীয় মেম্বর সাইদুরজ্জামান। প্রায় ৭ ফুট দেওয়াল গাঁথাও হয়েছে। ঘর দেখতে এসেছিলেন চেয়ারম্যানসহ বিদেশী সাহেবরা। কিন্তু মাস খানেক ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে। ইতোমধ্যেই বৃদ্ধের সদ্য নির্মিত ঘরের একটি কক্ষের পেছনের দেয়াল ভেঙে পরেছে। তিনি শুনেছেন বিদেশীরা পালিয়ে গেছে। তাই তার ঘর আর তৈরী হচ্ছে না। ৮ম শ্রেণিতে পড়–য়া এক মেয়ে ও স্ত্রী সুন্দরী খাতুনকে নিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে প্রতিবেশীর বারান্দায় কাপর টাঙিয়ে বসবাস করছেন তিনি। ঘরপাবার আশায় নিজে সেই পুরাতন ঘরটিও বিক্রি করে নতুন ঘরের মেঝেতে মাটি দিয়েছিলেন। কথাবলার সময় কান্নায় ভেঙে পরেন বৃদ্ধ। এখন সে কোথায় যাবে এই বিলাপই তার মুখে।

এই চক্রের খপ্পরে পরেছেন বয়বৃদ্ধ বিধবা ছকিরন নেছা। একমাত্র বসত ঘরটি ভেঙে সেখানে পাকা ঘর নির্মান শুরু করেছিলেন একই ওয়ার্ডের মেম্বর। কিন্তু ঘর আর পাকা হয়নি। নিজের শুন্য ভিটায় বসে বিলাপ করছিলেন তিনিও। ঘর ভাঙ্গার পর থেকে প্রায় ২ মাস ধরে এক প্রতিবেশীর ঘরে থাকছেন তিনি।

৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর আব্দুল মজিদ জানান, প্রতিটি বাড়ি নির্মানের জন্য জন্য ৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দের কথা শুনেছিলেন। তাদের দেওয়া ডিজাইনে প্রতিটি বাড়ি তৈরীতে ব্যয় হওয়া কথা ছিল ৩ লাখ টাকার মত। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থদের উন্নয়নে ৪ কোটি টাকার প্রকল্প পাওয়ে দেওয়ার জন্য তার কাছ থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্রের প্রধার রুবেল আহম্মেদ। একই ভাবে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বাবুল আখতার, থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম বাবুল, রাজু আহম্মেদ, ইট ভাটার মালিক আব্দুল মজিদসহ অন্যান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এসব টাকা হাতিয়ে নেয়।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল আখতার বলেন, এলাকার দুস্থ মানুষ সাহার্য পারে এমন ভরসায় তিনি সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়েছেন। তিনি না বুঝে প্রতারক চক্রের প্রধান রুবেলকে টাকা দিয়েছেন। পরিষদের অন্য কেউ কেউ গোপনে তাকে টাকা দিয়েছেন শুনেছেন। তবে এক পর্যায়ে তিনি সবাইকে সাবধান কিেছলেন। তিনি রাজধানীর একটি থানায় মামলা করেছেন। সেই মামলায় প্রতার রুবেল আটক ও রিমান্ডে আছে। সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়নি বলেও তিনি দাবি করেন। তিনি এও বলেন, প্রায় ১শ বাড়িতে দুই লাখ টাকার ইট বালি দেওয়া হয়েছে।