ঊর্ধ্বতন নারী সহকর্মীকে “স্যার” বলার সংস্কৃতি!!!

0
814
MUNSHE-MOR-DRO-26-P1
ড. মুন্সী মুর্তজা আলী

ড. মুন্সী মুর্তজা আলী

নিম্নপদের নারী ও পুরুষ সকল সহকর্মী নির্বিশেষে তাদের ঊর্ধ্বতন নারী সহকর্মীকে “স্যার” বলে সম্বোধন করার সংস্কৃতি আগে কখনো চালু ছিল না। কিন্তু ইদানীং বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি চালু হয়েছে। “স্যার” একটি পুরুষ লিঙ্গবাচক শব্দ। যার বাংলা অর্থ জনাব বা মহাশয়। স্যার এর স্ত্রীলিঙ্গ করলে অর্থ দাঁড়ায়, “মিস” বা “ম্যাডাম”। মিস ও ম্যাডাম দুটোই ইংরেজী শব্দ। অথচ আমাদের মানসিক ধারণা এমন হয়ে গিয়েছে যে, আপা বলার পরিবর্তে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করলে অধিকাংশ মহিলারা গর্ববোধ করেন। মিস ও ম্যাডামের অর্থের মধ্যেও ভিন্ন অর্থ লুকানো আছে। মিস মানে কুমারী। যদিও উন্নত দেশে অফিসিয়ালী ও আনঅফিসিয়ালীভাবে বিবাহিত ও অবিবাহিত মহিলাদেরকেও মিস বলে সম্বোধন করে থাকে। আর আমাদের দেশে ম্যাডাম বলতে আগে বিবাহিত মহিলাদেরকে বোঝাতো।

এখন সেখান থেকে মনেহয় আমরা একটু সরে এসেছি। মূলত ম্যাডাম অর্থ সম্ভ্রান্ত রমণীকে ভদ্রতাসূচক সম্বোধন, যাকে বাংলায় বলে ভদ্রমহিলা। সম্ভারন্ত রমণীকে তো আর “ভদ্রমহিলা” বলে ডাকলে শ্রুতিমধুর শোনা যায় না। তাই সম্ভ্রান্ত রমণীকে কিংবা উচ্চস্তরের চাকুরীজীবী মহিলাকে ম্যাডাম বলে ডাকায় অধিকতর শ্রেয় বলে মনে করা হয়। যদিও আপা বলেও সম্বোধন করলেও শ্রেয় হয় এবং অনেকে তা করেও।

আমাদের বাংলাদেশের কালচারটা হলো এরকম। স্কুলের শিক্ষিকাকে আমরা আপা বলে ডাকি। আর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে ম্যাডাম বলে ডাকি। এখন অবশ্য বেশীরভাগ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা মহিলা শিক্ষিকাদের ম্যাডাম বলার পাশাপাশি ম্যাম বলেও ডাকে। এখন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র বা ছাত্রী যদি তার শিক্ষিকাকে ম্যাডাম বা ম্যাম না বলে স্যার বলে সম্বোধন করে, তাহলে আমি শতভাগ নিশ্চিত যে সেই শিক্ষিকা বির্বত বোধ করবেন। কারণ, মহিলা শিক্ষিকরা এখনো সৃষ্টিশীল বাঙালি ঐতিহ্য ধারণ করে আছেন।

এখানে আপা থেকে ম্যাডাম কথাটি যেন আমরা বেশী প্রেস্টিজিয়াস মনে করছি। কারণ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদেরকে আমরা বেশী শিক্ষিত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বলে মনে করছি। যেহেতু তাঁরা মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। অবশ্য সাম্প্রতিককালে অনেক প্রাইমারী ও হাইস্কুলের বেশীরভাগ শিক্ষক শিক্ষিকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। শিক্ষক শিক্ষকই। সে যে কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা শিক্ষিকাই হোক না কেন। সকল শিক্ষকের মর্যাদা সমান। কারণ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সে তার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষককে সবসময়ই মর্যাদা প্রদান করে থাকে। অথচ বেশীরভাগ মানুষের ভাবনা এরকম তা হলো, প্রতিষ্ঠানভেদে শিক্ষকদের মর্যাদা ভিন্ন ভিন্নভাবে ভাবা। এটা একটা আমলাতন্ত্রিক মানসিকতা ছাড়া কিছুই নয়।

এদিকে আমাদের দেশের সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে ঊর্ধ্বতন মহিলা কর্মকর্তাকে (মহিলা কর্মকর্ত্রী) তাদের অধঃস্তন কর্মকর্তারা বা কর্মচারীরা স্যার বলে সম্বোধন করেন। শুধু তাই নয়, মাঠ পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে নিয়োজিত মহিলা কর্মকর্তাদেরকে নাকি এলাকার লোকজন যেয়ে স্যার বলে সম্বোধন করেন। তা না করলে নাকি অনেক মহিলা কর্মকর্তা মন খারাপ করেন অর্থাৎ বিব্রতবোধ করেন। এমনকি রাগও করেন। এখন নাকি রেওয়াজ হয়ে গেছে সকল মহিলা কর্মকর্তাদেরকে স্যার বলে সম্বোধন করতে হয়। আমার কাছে বিষয়টি একটু চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁয়িয়েছে। আমার মনে হয়, একজন মহিলা কর্মকর্তাকে স্যার বলে সম্বোধন করলে তো সেই মহিলা কর্মকর্তারই বিব্রতবোধ করা উচিত। অথচ সে বিব্রতবোধ না করে তুষ্ট হচ্ছেন। সব মহিলা কর্মকর্তারাই কি তুষ্ট হন? আর সব মহিলা কর্মকর্তারাই কি বিব্রত হন? এ নিয়ে আমার মনে দ্বীধা আছে। আমার ধারনা এতে সবাই তুষ্ট হন না। হয়তো কেউ কেউ বিব্রতও হন।

মহিলা কর্মকর্তাকে স্যার বলে সম্বোধন করে প্রকারান্তরে মহিলাদেরকে সম্মান করার বদলে শুধু অসম্মান করাই নয় তাদেরকে অপমান করা হচ্ছে বলেই আমার মতামত। নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক পুরুষ ও
নারীরই স্বাত্যন্ত্রবোধ আছে। কিন্তু যখন কোন নারী কর্মকর্তাকে ম্যাডাম না বলে স্যার বলা হয়, তখন এটা পুরো চাকুরীজীবী নারী সমাজের জন্য বিব্রতকর বিষয় হওয়া উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি। নারী কর্মকর্তাকে স্যার বলার মাধ্যমে নারীকে তার প্রাপ্য “নারী অধিকার” থেকে বঞ্চিত করার পুরুষ শাসিত সমাজের আরেকটি কৌশল বলেই আমি মনে করি। এতে নারী কর্মকর্তাদের তুষ্ট হওয়া বাতুলতা মাত্র। আশাকরি আমাদের বোধোদয় হবে।

পরিশেষে শরৎ চন্দ্রের একটি কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। সোনাকে রুপা মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দিলে, সোনা কখনো রুপা হয়ে যায় না। আর রুপাকে সোনা মনে করে সিন্দুকে তুলে রাখলেও রুপা কখনো সোনা হয়ে যায় না। আমাদের তথাকথিত নারীবাদী পুরুষেরা নারীকে রুপা মনে করে সোনার সিন্দুকে আটকে রেখে নারীকে মিছে নারী অধিকারের গোলক ধাঁধায় ফেলতে চায়। নারীদেরকে “স্যার” বলে ডাকার রেওয়াজ সৃষ্টি নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির পরিবর্তে নারীর মর্যাদা হানি ও অপকৌশল ছাড়া আর কিছুই না।

ড. মুন্সী মুর্তজা আলী, অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।