নিরব কান্নায় বৃষ্টি ছাড়া প্রথম ঈদ

0
28
বৃষ্টি খাতুন ছাড়া প্রথম ঈদের সকালে মা বিউটি খাতুন নিরবে চোখের জলফেলে কাটালেন

স্টাফ রিপোর্টার

বড় মেয়ে বৃষ্টি খাতুন ছাড়া প্রথম ঈদের সকালে মা বিউটি খাতুন নিরবে চোখের জলফেলে কাটালেন। নিহত মেয়ের ব্যবহারের জিনিস পত্র ফেরত আনার পর বাড়িতে নতুন করে শোকের মাতম শুরু হয়েছে। ঈদের দিন সমাজে সিন্নি পাঠানোর হয়নি। ছোট দুই মেয়ে ঝর্ণা ও বর্ষাসহ পরিবারের কেউই নতুন কাপড় পরেন নি। সদ্য সন্তান হারা সাবলুল আলম সবুজের এক বোন সামান্য কিছু ফিন্নি সেমাই রান্না করেছে কিন্তু দুপুর পর্যন্ত পরিবারের কেউ তা ছুয়েও দেখেনি।

খোকসার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের বনগ্রাম পশ্চিম পাড়ার নিহত সাংবাদিক বৃষ্টি খাতুনের বাড়িতে ঈদের আমেজ নেই। বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ১০টা, গ্রামে সবে ঈদুল ফিতরের ঈদের জামাতায় শেষ হয়েছে। কিন্তু ঈদের আনন্দে যেন বিষাদের ছায়া ফেলেছে নিহত সংবাদিক ও ইডেন কলেজের ছাত্রী বৃষ্টি খাতুনের গ্রামের বাড়ি জুড়ে। বাড়ির প্রবেশ পথের পাশের সিঁড়িতে বসে মেয়ের থাকার ঘরের দরজার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মা বিউটি খাতুন। তার দুই চোখ দিয়ে জলের ¯্রােত বইছে। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে ৬ষ্ঠ শ্রেনির এক শিশু ও ঢাকার একটি কলেজের ছাত্র প্রতিবেশীর ছেলে। ঈদের দিন সকালে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান রুকুসহ অনেকেই শোকার্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে বৃষ্টির বাড়িতে আসেন।

নিহত বৃষ্টির ব্যবহারের জিনিস পত্র নিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে বাড়ি ফিরেছে বাবা সাবলুল আলম সবুজ শেখ। মেয়ের মোবাইল ফোন, এসএসসি ও এইচএসসি পাশের সাটিফিকেট ছাড়া বাঁকী ব্যহারের জিনিস পেয়েছেন। ঈদের দিন সকাল সাতটার আগে ঈদের নামাজ পরার উদ্যেশ্যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে তিনি আর ফেনেনি। ফোনও রিসেভ করলেন না। পরে তার ভাই জোয়াদ আলী জানালেন, মেয়ের জন্য জাকের পার্টির পক্ষ থেকে কুষ্টিয়া জেলা সদরে একটি দোয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি সেখানে গেছেন।

নিহত বৃষ্টির থাকার ঘরের দরজার দিয়ে নিস্পলক তাকিয়ে থাকা মা বিউটি খাতুনের দুই চোখের জলের যেন ¯্রােতের ধারা কিছুতেই কমছেনা। কথা বলার স্বক্ষমতাও যেনো হারিয়ে ফেলেছেন। কয়েকবার জানতে চাওয়ার পর মৃদু স্বরে জানালেন, “আমার জীবনে আর কোন শখ আল্লাদ এখন নেই। কোথায় সিন্নি! কোথায় কি?” আবার শুরু করলেন নিরব কান্না।

বড় আপা (বৃষ্টি) ছাড়া ঈদ ভালো যাচ্ছে না ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী কুলসুমের। বৃষ্টি তার চাচাত বোন। প্রতি বছর ঈদের দিন সকালে আপু (বৃষ্টি) তার হাতে মেহেদী দিয়ে দিতো। সাজগোজ করাতো। অনেক গল্প বলত। সারদিন কাছে কাছে রাখতো। এবার আর বড় আপু নেই। তাকে কেউ চুড়ি পড়িয়ে দেয়নি। সাজিয়ে দেয়নি। অনেক কষ্ট করে নিজেই সেজেছে।

২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার গ্রীন রোর্ডের অগ্নিকান্ড শুরুর কয়েক মিনিট পর প্রতিবেশীর ছেলে ও ঢাকার একটি কলেজের ছাত্র তামিম আহম্মেদ বৃষ্টিকে ঘটনাটি জানিয়ে মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়েছিল। কিন্তু আর ফিরতি মেসেজ দেয়নি বৃষ্টি। পরদিন শুক্রবার (১ মার্চ) সে টেলিভিশনের খবর দেখে বৃষ্টির মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়। এ শিক্ষার্থী জানায়, বৃষ্টি তার বড়। বাড়ির সামনা-সামনি বাড়ি হওয়ায় তার সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল। বৃষ্টি মাথায় সব সময় বড় হওয়ার স্বপ্ন কাজ করতো।

বৃষ্টির চাচি সুইটি খাতুন জানান, রোজিনা খাতুন নামের তার এক ননদ এসে কিছু খাবার তৈরী করেছেন। কিন্তু এ বেলা পর্যন্ত কেউই খায়নি (বেলা ১২টা)। কলেজ ছাত্রী মেজোমেয়ে ঝর্ণা ঘরে বসে বৃষ্টির বেডিং বুকচা ধরে কাঁদছেন। ছোট মেয়ে বর্ষা বোনের জন্য কাঁদছে, কোরআন পড়ছে, আবার বাবার সংসারের কাজ করছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে খোকসা উপজেলা সদরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে বৃষ্টির বাবা সাবলুল আলম সবুজ শেখের সাথে দেখা করে কথা বলা হয়।

বৃহস্পতিবার দুপুরে খোকসা উপজেলা সদরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে বৃষ্টির বাবা সাবলুল আলম সবুজ শেখের সাথে দেখা করে কথা বলা হয়। তিনি জানান, খুব সকালে জাকের পাটির দোয়ার মাহফিল ও ঈদের জামায়াতে শরিক হওয়া জন্য কুষ্টিয়া গিয়েছিলেন। প্রয়াত মেয়ের শিক্ষা সনদ ও মোবাইল ফোন টি এখনো হাতে পাননি। মঙ্গলবার রাতে মেয়ের পোশাকসহ ব্যবহারের জিনিসি বাড়ি এনেছেন। তবে যারা তার মেয়ের লাশ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করার সাথে জড়িতদের বিচারের মুখমুখি করার দাবি জানান।

পারিবারিক সূত্র জানায়, বৃষ্টি খাতুন বনগ্রাম পশ্চিমপাড়া উপানুষ্ঠানিক প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে প্রাথমিক সমাপনী পাস করেন। ২০১০ সালে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে এসএসসি উত্তীর্ণ হন ২০১৫ সালে। একই বিভাগ নিয়ে কুষ্টিয়া সরকারি গার্লস কলেজ থেকে ২০১৭ সালে এইচএসসি পাসের পর ২০১৮ সালে ইডেন মহিলা কলেজে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। তবে দুটি সেমিস্টারে অংশ নেওয়ার পর অনিয়মিত হয়ে পড়েন। অনলাইন সংবাদমাধ্যম দ্য রিপোর্টে ডটলাইভে অভিশ্রæতি শাস্ত্রী নামে শিক্ষানবিশ সংবাদকর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতে ওই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছেড়ে দেন। নতুন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরুর কথা ছিল। ২৯ ফেব্রুয়ারি এক বন্ধুর সঙ্গে বৃষ্টি রাতের খাবার খেতে যান রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের একটি রেস্তোরাঁয়। সেখানে ভয়াবহ আগুনে ৪৬ জন মারা যান। তাদের একজন বৃষ্টি। তবে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নাম নিয়ে রহস্য দেখা দেয়। পরে ডিএনএ টেস্টে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ১১ মার্চ দুপুরে বাবা সাবলুল আলম সবুজ শেখের কাছে তাঁর মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। সে রাতেই নিজ গ্রাম খোকসার বনগ্রাম পশ্চিম পাড়ায় পারিবারিক কবর স্থানে তার দাফন করা হয়।