খোকসায় ক্ষুরা রোগে ২ শতাধিক গরুর মৃত্যু

0
192

খামারী ও কৃষকের ক্ষতি দেড় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে

স্টাফ রিপোর্টার

ক্ষুরা রোগে ৪টি গরু মারা গেছে আশা রানী বিশ্বাসের। গরুর দুধ বিক্রি করে দুই ছেলের কলেজে পড়ার খরচসহ ৫ জনের সংসার চালাতেন। গত এক মাসে খোকসা উপজেলার তিন ইউনিয়নের খামারীদের প্রায় ২ শতাধিক গরু মারা গেছে। যার ক্ষতির পরিমান দেড় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে খামারী-কৃষক ও পল্লী পশু চিকিৎসকরা দাবি করছেন। অথচ উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার এ দাবি নাকোচ করে বললেন, একটি গরুও মারা যায়নি। আক্রান্তের সংখ্যাও সামান্য।

উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, খোকসা উপজেলার ৯ ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৬৬টি গাভী গরু ও ষাঁড় মোটাতাজা করার খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রায় ৩২ হাজার ৯০ টি দুধ দেওয়ার উপযোগী গাভী ও ১২ হাজার ৯৪৬টি মোটা তাজা করনের ষাঁড় গরু পালন করা হচ্ছে।

সরেজমিন গিয়ে ভুক্তভোগী খামারী-কৃষক ও পল্লী পশু চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাস দু’য়েক আগে উপজেলার পদ্মা নদী তীরবর্তী আমবাড়িয়া, জয়ন্তী হাজারা ও গোপগ্রাম ইউনিয়নের গরুর খামার গুলোতে গবাদি পশুর ক্ষুরা রোগ (মুখ ও পায়ে ঘা) দেখা দেয়। আক্রান্ত গরু গুলো খাওয়া বন্ধ করে দেয়। রোগটি দ্রæত ছড়িয়ে পড়ায় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত উপজেলার ৭০ শতাংশ গরু ক্ষুরা রোগে অক্রান্ত হয়েছে। গরুর খামার গুলোতে নতুন করে লাম্পি স্কীন ডিজিজ (এলএসডি) নামের রোগের আক্রমন যোগ হয়েছে। এসব রোগে শুধুমাত্র জয়ন্তী হাজরা ইউনিয়নের উত্তর শ্যামপুর, ঝালুকাদহ, ধুসুন্ডা, ফুলবাড়ি গ্রামে শতাধিক গরু মারা গেছে। এ ছাড়া উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত গরু মরা যাওয়া খবর পাওয়া যাচ্ছে।

উত্তর শ্যামপুর গ্রামের আশা রাণী বিশ্বাসের গোয়ালে দুটি গাভী গরুসহ ৫ টি গরু ছিল। এক মাসে তার খামারে ক্ষুরা রোগে দুটি গাভীসহ ৪টি গরু মারা গেছে। এ গৃহীনির স্বামী নিশীকান্ত বিশ্বাস মাত্র দুই বিঘা কৃষি জমির মালিক। বড় ছেলে সাগর বিশ্বাস খোকসা সরকারী ডিগ্রী কলেজের বিএ (সম্মান) ও ছোট ছেলে সৈকত বিশ্বাস শোমসপুুর আবু তালেব ডিগ্রী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়েন। দুই সহদরের কলেজে পড়ার খরচসহ ৫ জনের সংসার চলত দুধ বিক্রির টাকা দিয়ে।

গ্রামের পাকা রাস্তা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার কাদার মাটির এক পায়া পথ পাড়ি দিয়ে সরেজমিন গিয়ে উত্তর পাড়ার আশা রাণীর সাথে কথা বলা হয়। নিজে কাঁচা ঘরে বাস করেন। কিন্তু খামারের গরুর জন্য তুলেছিলেন ইটের আধাপাকা ঘর। এখানেই পালতেন দুটি গাভীসহ ৫টি গরু। সেই ঘরে অবশিষ্ট একটি মাত্র গরুর পরিচর্যা ব্যস্ত ছিলেন। একমাস আগে তার একটি বাছুর গরু খাওয়া বন্ধ করে দেয়। স্থানীয় এক পল্লী চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করান। ওষুধ কাজে আসেনি। বাছুর গরুটি মারা যায়। কয়েক দিনের ব্যবধানে নিজের চোখের সামনে ৪টি গরু মরতে দেখেছেন। তার গরু গুলো বাজার মূল্য ৫ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। গরু মারা যাওয়ার পর আশা রাণীর জীবন সংসার থমকে গেছে।

ফুলবাড়ি পূর্ব পাড়া গ্রামের গরুর খামারী আনোয়ার হোসেন। ১৫ দিনের ব্যবধানে তার খামারের ফিজিয়ান জাতের ৭টি গরু মারা গেছে। তার ক্ষতির পরিমান ১০ লাখ টাকার ছাড়িয়ে যাবে। একই মহল্লার পল্লী পশু চিকিৎসক নিজাম উদ্দিনের ১টি গরু, সাইদুল মন্ডলের ১টি, লথিপ মন্ডলের ১ টি, জব্বার প্রামানিকের ১টি, মিজান মন্ডলের ১টিসহ একই মহল্লায় ১২টি গরু মারা গেছে। এ ছাড়া ঝালুকাদহ গ্রামের আকামদ্দিনের ৩টি গাভী গরু, আছামদ্দিন ওরফে আছাই মিস্ত্রীর ৩টি, লথিপ প্রামানিকের ২টি, ধুসুন্ডা গ্রামের কামাল বিশ্বাসের ১টি, হেলালের ২টি, আতিয়ারের ১টি, রাজু’র ১টিসহ প্রায় শতাধিক গরুর মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

গত সপ্তাহে খোকসা পৌর এলাকার পাতিলডাঙ্গী গ্রামে রাজু আহম্মেদের ১টি, কোরবান আলীর ১টি ও নায়েব আলীর ১টি গরু মারা গেছে।

পল্লী পশু চিকিৎসক নিজাম উদ্দিন দাবি করেন, পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধির পর পদ্মাচরের বাথানের গরু খামারে ফিরিয়ে আনা হয়। আর এখান থেকে ক্ষুরা রোগের সৃষ্টি ও বিস্তার ঘটেছে। তার দাবি ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ গরু ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে। ইতোমধ্যেই এ উপজেলায় প্রায় ২ শাতাধিক গরুর মৃত্যু হয়েছে বলেও তিনি নিশ্চিত করেন। উপজেলা ব্যাপী ক্ষুরা ও লাম্পি স্কিন রোগের ব্যপক পদুভাব ঘটেছে।

তিনি আরও জানান, গরুর মরক মহামারী আকার ধারণ করায় প্রতিটি কৃষক পরিবারের হাহাকার শুরু হয়েছে। ক্ষুরা রোগের কোন প্রতিশেধক নাই। এ সুযোগে প্রতারক শ্রেণীর কবিরাজরা গরু চিকিৎসার নামে চুটিয়ে ব্যবসা করে নিচ্ছে।

ধুষুন্ডা গ্রামের পাতা মন্ডল নিজে একজন খামারী। তার খামারের ৪টি গরুর মধ্যে ১টি ষাঁড় গরু তিন দিন খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। গরুটির চিকিৎসায় ইতোমধ্যে ১৬শ টাকা ব্যয় করেছেন। তিনি অবশ্য হোমিওপ্যাথ ও এ্যালোপ্যাথি মিলিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ভাষ্যমতে যে বাড়িতে গরু আছে সেই বাড়িতে ক্ষুরা রোগ আছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পশু হাসপাতালের ডাক্তাররা বছরে একবারও ফিরে ফুচকি দেয় না।

খামারী আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, পাঁচ বছরের একবারও তিনি সরকারী পশু হাসপাতালের ডাক্তারের দেখা পান নি। প্রতিবছর এসব খামারিরা কোটি কোটি টাকার দুধ বাজার জাত করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে। তিনি দাবি করেন, গরু রোগাক্রান্ত হওয়া ও মারা যাওয়ার ফলে এলাকায় দুধের আকাল হতে পারে। এই মহামারীর সময়ে পশু হাসপাতালের সরকারী ডাক্তারদের ডেকেও পাননি।

জয়ন্তী হাজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর মাহাতাব উদ্দিন মন্ডলের নির্বাচনী এলাকায় একমাসে ১২ থেকে ১৫টি গরু মারা গেছে। এর মধ্যে ১২-১৩ মন ওজনের গরুও ছিল। এ ওয়ার্ডে মারা যাওয়া গরুর মধ্যে গাভী ও বাছুর গরু বেশী ছিল। মহামারীর মধ্যেও সরকারী পশু হাসপাতালের ডাক্তাররা একবারও আসে। তিনি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনার চেষ্টা করেছেন।

আমবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকমল হোসেনের এলাকায় ব্যপক হারে ক্ষুরা ও লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুভাব ঘটেছে। তার ইউনিয়নে আক্রান্ত ও মারা যাওয়া গরুর সংখ্যা প্রচুর। তবে মারা যাওয়া গরুর সঠিক পরিসংখ্যান তার কাছে নেই।

উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ শাহানা বেগমের সাথে কথা বলা হয়। কৃষকের এতো গরু মরা গেছে বলে তিনি মানতে নারাজ। কোথাও কোন গরু মারা গেছে এমন খবর তিনি শোনেনি। তবে কিছু কিছু এলাকায় বিশেষ করে দুধের পকেট খ্যাত আমবাড়িয়া ইউনিয়নে এক/দুটি গরু জ্বরা (ক্ষুরা) রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে শুনেছেন। এ রোগের কোন প্রতিশেধক নেই বলেও তিনি জানান। তিনি বলেন, পাশের উপজেলা গুলোর তুলনায় তার উপজেলাতে জ্বরা (ক্ষুরা) রোগে আক্রান্ত পশুর নেই বললেই চলে। জ্বরা (ক্ষুরা) রোগটিকে আমদানী কৃত বলেও তিনি দাবি করেন।

উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা রিপন বিশ্বাস এ বিষয়ে অবগত আছেন। এ নিয়ে উপজেলা পরিষদের সাধারণ সভায় আলোচনা হয়েছে। প্রণি সম্পদ কর্মকর্তা জানিয়ে ছিলেন ভ্যাকসিন শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে ভ্যাকসিনের চাহিদা দেওয়া হয়েছে।