শুধু মুচলেকা নিয়ে ফিরলো প্রশাসন
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
তিন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাব, আনছার, ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ অন্তত ৬০ জনের একটি সজ্জিত দল যাচ্ছিলেন অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযানে। তবে তারা একটি ইটভাটাতেও অভিযান পরিচালনা করতে পারেনি। নারায়েতকবির ‘শ্লোগান দিয়ে ঝটিকা অভিযান আটকে দেয় অবৈধ ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা। পথে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরোধ থাকার পর সাদা কাগজে শুধু ভাটা মালিকদের মুচলেকা নিয়ে কোনমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে গেলেন ভ্রাম্যমান আদালতের বিশাল বহর।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চরসাদিপুর ইউনিয়নের ভোমরার মোড়ে বুধবার বেলা ১১ টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত অবরোধেরর পর মুচলেকা নেওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখানে কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী ও পাবনা সদর উপজেলা প্রশাসন এবং কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চালাতে গিয়ে বাধার মুখে ফিরে আসেন।
ভ্রাম্যমান আদালতের নেতৃত্বে ছিলেন- কুষ্টিয়া সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিফাতুল ইসলাম, কুমারখালী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আমিরুল আরাফাত, পাবনা সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুরাদ হোসেন ও কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হাবিবুল বাসার।
প্রশাসনের কর্তাদের ভাষ্য, পদ্মা নদীর কুলঘেঁষে চরসাদিপুর একটি দুর্গম চরাঞ্চল এলাকা। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। নৌকা একমাত্র চলাচলের যানবাহন। সেখানে অন্তত ৩০ টির অধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। শত চেষ্টার পরও অবৈধ এসব ইটভাটার মালিক- শ্রমিকদের বাঁধার মুখে অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন প্রয়োগ না করেও ফিরে এসেছেন তাঁরা। , আগামী বছর মালিকরা অবৈধ ভাটা চালাবেন না, ‘এই মর্মে শুধু মুচলেকা নিয়ে ফিরে আসা হয়েছে।
তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, পদ্মার কারণে চরসাদিপুর এলাকায় প্রশাসনের নজরদারি নেই। ফলে কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে অংসখ্য অবৈধ ভাটা। ভাটায় পুড়ানো হচ্ছে নদী ও ফসলি জমির মাটি ও কাঠ। ভেঙে পড়ছে গ্রামীণ সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভেঙে পড়েছে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সেজন্য অবৈধ ভাটা মালিকদের বাঁধার মুখে অবৈধ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা না করেই ফিরে গেছেন প্রশাসনের কর্তারা।
জানা গেছে, পদ্মা নদীর কুলঘেঁষে ২২ বর্গমাইল আয়তন নিয়ে গঠিত কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চরসাদীপুর ইউনিয়ন। এখানে প্রায় ২৩ হাজার মানুষের বসবাস। বিভিন্ন সময়ে ভাঙনে প্রায় পাঁচ বর্গমাইল ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আর অবশিষ্ট প্রায় ১৭ বর্গকিলোমিটারে বসতি এবং তিন ও দুই ফসলি কৃষি জমি। সেখানে আইন অমান্য করে গড়ে ওঠেছে প্রায় ৩৩ টি অবৈধ ইটভাটা। যার মধ্যে অন্তত ১৯টিতে ব্যবহার হচ্ছে টিনের ড্রাম চিমনি। এছাড়াও ইউনিয়ন ঘেঁষে কুষ্টিয়া সদর ও পাবনা অংশজুড়ে রয়েছে আরো অন্তত ৭ টি ভাটা। যার সব গুলোই অবৈধ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রস্থের পদ্মা নদীর সাড়ে তিন কিলোমিটার চর জেগেছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সদস্যরা নৌকা যোগে ও পায়ে হেঁটে নদীপাড় হন। পরে তারা ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল যোগে চরসাদিপুর ইউনিয়নরের ভোমরার মোড় এলাকায় পৌছালে নারায়েতকবির দিয়ে ঘোষণা দিয়ে ভাটা মালিক, শ্রমিকসহ কয়েক শত লোক তাদের পথ আটকে দেন। সেখানে প্রায় আড়াই ঘণ্টা প্রশাসনের সঙ্গে অবৈধ ইটভাটার মালিক-শ্রমিকদের তর্কবিতর্ক হয়। একপর্যায়ে মুচলেকা নিয়ে ফিরে আসেন কর্মকর্তারা।
এসময় অবৈধ এবিসি ভাটা মালিক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ব্যাংক লোন ও ধারদেনা করে অবৈধভাবে ভাটা চালাচ্ছি আমরা। অন্তত ১৯ টি ড্রাম চিমনিসহ ৪০ টি অবৈধ ভাটা রয়েছে। সেখানে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করে। সেজন্য তাদের জীবিকার কথা চিন্তা সম্মিলিত ভাবে অভিযানে বাঁধা দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর আর অবৈধ ভাটা চালাবো না, এই মর্মে মুচলেকা দিয়েছি।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কুমারখালী সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমিরুল আরাফাত বলেন, দুর্গোম চরসাদিপুর এলাকায় ৩০টির অধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে অবৈধ ভাটায় অভিযান চালাতে তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাব, আনছার, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্তত ৬০ জনের একটি দল যাচ্ছিলেন। তবে ভাটা মালিক ও শ্রমিকরা পথেই অভিযান আটকে দিয়েছেন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়েও ভাটায় পৌছানো যায়নি। সেখানে জনগণের জান ও মালের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর ভাষ্য, আগামী বছর আর অবৈধ ভাটা চলবে না, এই মর্মে ভাটা মালিকদের মুচলেকা নেওয়া হয়েছে।
আর সরকারি কাজে বাঁধা প্রদানকারীদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানালেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। তিনি বলেন, পরবর্তীতে আরো গুছিয়ে সুসজ্জিত ভাবে চরসাদিপুরে অভিযান চালানো হবে।
আরও পড়ুন – খোকসা হানাদার মুক্ত দিবস পালিত
গত সোমবার (২ ডিসেম্বর) কুষ্টিয়ার মিরপুরে অবৈধ ইট ভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের বাধার মুখে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমান আদালতের টিম নামমাত্র পাঁচটি ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করে ব্যর্থ হয়ে কুষ্টিয়ায় ফিরে আসে।
আরওপড়ুন – খোকসায় পূবালী ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকিং উদ্বোধন
বার বার অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কেন ব্যর্থ হচ্ছে অভিযানএমন প্রশ্নের জবাবে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই প্রশাসন অভিযান পরিচালনা না করেই ফিরে এসেছে। তবে আগামীতে আরো ব্যাপক প্রস্তুতি ও সতর্কতা অবলম্বন করে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানান তিনি।