গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পাঁচ দিন পর মামলা

0
66
মায়ের ছবি খুজছে শিশু হুমাইয়া। উৎসুক শিশুরা তাকে ঘিরে রেখেছে। (ইনসেডে চিকিৎসাধীন গৃহবধূ রহিমা খাতুন সাগরিকা)

স্টাফ রিপোর্টার

রহস্যজনক কারণে কয়েকদিন গোপন রাখার পর বেড়িয়ে এলো গুলিবিদ্ধ গৃহবধূ ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার (গৃহবধূ) গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে স্বামীর পক্ষ। অবশেষে গৃহবধূর শ্বশুর আত্মগোপন থেকে ফিরে পাঁচ দিনের মাথায় এ ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন। ঘটনার পর থেকে গৃহবধূর স্বামী আত্মগোপনে রয়েছেন।

গুলিবিদ্ধ গৃহবধূর নাম রহিমা খাতুন সাগরিকা (২৩)। সে খোকসার জয়ন্তি হাজরা ইউনিয়নের উথলি গ্রামের আসলাম প্রামানিকের ছেলে হাবিব প্রামানিকের স্ত্রী। তার দু’টি সন্তান রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (২৯ মে) রাত ১১টার পর স্বামীর বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে রাস্তায় গৃহবধূ রহিমাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। স্বামীর পরিবারের লোকেরা সে রাতেই অত্যন্ত গোপনে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত আহত গৃহবধূকে প্রথমে পাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখান থেকে রেফার্ড করা হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সর্বশেষ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই ২০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর বিছানায় সে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আত্মগোপনে চলেযায় স্বামী হাবিব প্রামানিক। তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর টিও বন্ধ রয়েছে।

এ ঘটনায় সোমবার (৩ জুন) খোকসা থানায় মামলা দায়ের করেছেন আহত গৃহবধূর শ্বশুর আসলাম প্রামানিক। আনিস নামের এক যুবককে এ মামলায় আসামী করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে আদালতে সপর্দ করেছে। কিন্তু তার কাছ থেকে ঘটনায় ব্যবহৃত আগ্নে অস্ত্রটি উদ্ধার করা যায়নি। তাকে রিমান্ডও চাওয়া হয়নি।

গুলিবিদ্ধ গৃহবধূ রহিমা খাতুনের বাবার বাড়ি একই উপজেলার আমবাড়িয়া ইউনিয়নের আমবাড়িয়া গ্রামে। তার বাবা নাম মৃত শামসুদ্দিন। কয়েক বছর আগে মাও মারা গেছেন। সে বাবা মার একমাত্র সন্তান। প্রথম দফায় বাবার জমি বিক্রি করা ৪০ লাখ টাকা নিয়ে নেয় স্বামী হাবিব। এবার আরো প্রায় ২০ লাখ টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে না দেওয়া নিয়ে রহিমাকে গুলিকরা হয় বলে স্বজনরা দাবি করছেন।

গুলিবিদ্ধ গৃহবধূর চাচী জেসমিন জানান, তিনদিন আগে তারা রহিমা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা জানতে পারে। তারপর খোজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করেন। বার বার ফোন দেন। কিন্তু রহিমার ফোন বন্ধ পান। রবিবার সকালে রহিমার মৃত্যুর সংবাদ আসে। এরপর মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, রহিমা বেঁচে আছে। মেয়ের শ্বাশুরীর লোকদের কাছে থেকে ফোন নাম্বর নেওয়া চেষ্টা করেন। কিন্তিু তারা নম্বর না দিয়ে টালবাহানা করে। দেয়নি ঠিকানাও। তাদের পক্ষের গ্রামবাসীরা ঝামেলা পাকালে তারা ফিরে আসেন। পরে নাম্বর জোগার করে মেয়ের সাথে কথা বলেছেন। রহিমা জানিয়ে সে এখন একটু সুস্থ্য আছে। তাকে কে গুলি করঋ হয়েছে।

তাকে কে গুলি করেছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেসমিন ঘাতকের নাম বলতে অপারোগতা জানান। তিনি আরও বলেন, রহিমা যেহেতু বেঁচে আছে তাই তার কাছ থেকে জানেন। সে অস্ত্রধারীকে চিনেছে।

তিরি আরও জানান, প্রায় ১০ বছর আগে পাশের উথলি গ্রামের আসলাম শেখের ছেলে হাবিবের সাথে রহিমা খাতুন ওরফে সাগরিকার বিয়ে হয়। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় মৃত্যুর আগে শামসুদ্দিন তার সিংহ ভাগ জমি বিক্রি করে প্রায় ৪০ লাখ টাকা জামাতা হাবিবকে যৌতুক হিসেবে দেয়। কিছু দিন পর গৃহবধূর বাবা (শামসুদ্দিন) মারা যায়। এর পর হাবিব বাঁকী জমি বিক্রি করে দেওয়ার জন্য রহিমার উপর চাপ দিতে থাকে। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ চলছিল।

সোমবার দুপুরে উথলি গ্রামে সরেজমি গিয়ে সর্বত্র গৃহবধূ গুলিবিদ্ধের ঘটনা নিয়ে কানাঘুষা শোনা যায়। তবে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়া থাকা হাবিবের স্ত্রী কিভাবে গুলিবিদ্ধ হলো তা নিয়ে কেউ মুখ খুলেনা।

গুলিবিদ্ধ গৃহবধূকে উদ্ধার ও চিকিৎসার দায়িত্বে পালন করা আব্দুল আজিজের সাথে দেখা করা হয়। প্রায় ২৪ ঘন্টা পর থানা থেকে ছাড়া পেয়ে তখন সবে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। অনেকটা স্বেচ্ছায় ঘটনা স্থলে এসে তার দেখা দৃশ্যের বর্ণনা দিলেন। তিনি জানান, রাতে গুলির ঘটনার পর তিনি সেখানে উপস্থিত হন। গৃহবধূর পিঠের বাম পাশ পাশের ক্ষত দিয়ে রক্ত ঝড়ছিল। গৃহবধূর ওড়না দিয়ে বেঁধে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করেন। ফরিদপুর নেবার পর গৃহবধূ অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। তবে এখন গৃহবধূ সুস্থ্য আছেন। গুলির পর গৃহবধূর স্বামী হাবিব ঘটনা স্থলে ছিল না, এমনকী ঢাকাতেও যায়নি বলে তিনি নিশ্চিত করেন।

দুপুরে হাবিবের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। মায়ের বিছানায় খেলা করছিল শিশু হুমাইয়া (৫) ও নোমান (৩)। এই শিশুরা জানেনা মা কোথায়?

ওই গৃহবধূর ৫ বছর বয়সী বড়মেয়ে হুমাইয়া জানান, সেদিন বাবা বাড়ি ফিরে মাকে মারে। এরপর তারা দুই জনই ঘর থেকে চলে যায়। আর ফেরেনি। এরপর সে ছোট চাচির ঘরে ঘুমিয়ে পরেছিল।

গুলিবৃদ্ধ গৃহবধূর চাচা সাবেক সেনা সদস্য শহিদুল ইসলাম বলেন, বাবার বাড়ির সব সম্পত্তি বিক্রি করার জন্য কয়েক বছর ধরে রহিমা খতুনের উপর হাবিব চাপ দিয়ে আসছিল। সে হয়তো জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় তার উপর রাতের আঁধারে গুলি চালানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যে মামলা দায়ের হয়েছে সেখানে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করা হয়েছে। রহিমা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দুই তিনদিন ঘটনাটি গোপন রাখা হলো। তাদের খবর না দিয়ে চিকিৎসা করানোর মধ্যে দূরভিসন্ধি থাকতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।

মামলার একমাত্র আসামীর বাবা আক্কাস শেখ জানান, রহিমার সাথে তার ধর্ম মেয়ে সম্পর্ক। বাড়িতে সমস্যা হলেই রহিমা আনিসকে ফোন দিত। আর এই ফোন দেওয়ায় তার জন্য কাল হয়েছে। ঘটনার দিন তার ছেলে আনিস বাড়িতে ছিল। পুলিশের চাপে শনিবার রাতে আনিসকে থানায় পাঠান। এর পর আর পুলিশ তাকে ছাড়েনি। অবশেষে মিথ্যা মামলায় ছেলেকে ফাঁসিয়েছে।
গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় দায়ের কৃত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা থানা পুলিশের এসআই কবির হোসেনের সাথে কথা বলা হয়। তিনি জানান, মামলা তদন্তধীন আছে। এ ছাড়া ব্যবহৃত আগ্নেয়স্ত্রটি উদ্ধার হয়নি বলে স্বীকার করেন। তবে অস্ত্র উদ্ধার হতেও তো পারে বলেন মন্তব্য করে ফোনটি কেটে দেন।

থানা ভার প্রাপ্ত কর্মকর্তা আননুর যায়েদ জানান, গৃহবধূর পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে। গুলিটি তার বাম স্তনের নিচে এসে আটকে আছে। অপারেশন করে গুলিটি আপসারণ করা যায়নি। ওই গৃহবধূ এখনো ঝিকুতে রয়েছে। মহিলার স্বামী হাবিবের অবস্থান সর্ম্পকে তিনি বলেন, হয়তো স্ত্রীর চিকিৎসায় ব্যস্ত রয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসা বাদ করা হবে কী না এ প্রশ্ন করতেই তিনি এড়িয়ে যান।