আব্দুস সালাম খান
১৯৭৯ সালের কথা।
এক সাক্ষাতে চৌধুরী সাহেব সাপ্তাহিক ইস্পাত পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দিলেন। এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম। ছাত্রাবস্থায় কিছু লেখালেখির অভিজ্ঞতাকে পূঁজি করে এই দায়িত্ব নেয়া। বার্তাসম্পাদক বলে কথা, পত্রিকার সব দায়-দায়িত্ব কাধে নেয়া, কোন খবরের ভূল-ভ্রান্তি এমনকি বানান ভূলের দায়িত্বো আমার। তিনজন ষ্টাফ রিপোর্টার আমাকে সহায়তা করেন। কখনও হুমকি আসে “আপনার সাথে দেখা হবে”।
কাজে যোগদানের প্রথম দিনই চৌধুরী সাহেব আমাকে অবাক করলেন, সবেমাত্র কাজ শুরু করেছি। কয়েকটি প্রেস রিলিজ খবরে রুপান্তর করেছি। চৌধুরী সাহেব একটি সিনেমার টিকেট হাতে ধরিয়ে দিলেন। বনানী হলে একটি ইংরেজী সিনেমা চলছে। সাংবাদিকতার জন্য সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যান, দেখে আসেন। খবরের টেবিল ছেড়ে ছুটলাম সিনেমা হলে। সত্যিই দৃশ্যগুলো একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য শিক্ষনীয় । বেশ মজা পেলাম। এটাই জীবনের প্রথম ইংরেজী সিনেমা দেখা।

ওয়ালিউল বারী চৌধুরী ছিলেন সাংবাদিক গড়ার কারিগর। সেইজন্য ইস্পাত পত্রিকাকে অনেকে সাংবাদিক তৈরীর কারখানা বলতেন। গ্রাম-গঞ্জ থেকে পাঠানো খবর তাঁর সম্পাদনার গুনে পাঠযোগ্য হয়ে উঠত। গ্রামের সংবাদ দাতাদের খবরগুলো সাধারণত অগোছালো অবস্থায় আসে, কে কি কেন কখন কোথায় কিভাবে ঠিকমত সাজানো থাকে না। চৌধুরী সাহেব সেসব খবরগুলো পাঠযোগ্য করতে আমাদের গাইড দিতেন। এতে একটি সাধারণ খবরও মাজাদার হয়ে উঠতো।
চৌধুরী সাহেব প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকা কার্যালয়ে খবর তৈরীর সেশন চালাতেন। যেখবর গুলো ত্রুটিপূর্ণ, তথ্যহীন সেগুলো তিনি ফাইলে সংরক্ষণ করতেন। সংশ্লিষ্ট সংবাদ দাতারা পত্রিকা কার্যালয়ে এলে তিনি তাদের খবরের ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিতেন। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকা কার্যালয়ে বসত খবর তেরীর পাঠশালা। একজন অদক্ষ খবর লেখকও তাঁর সংস্পর্শে এসে দক্ষ খবর দাতা হিসাবে গড়ে উঠতেন। চৌধুরী সাহেব বৃহত্তর কুষ্টিয়ার দূর্গম গ্রামেও অনেক সংবাদ দাতা তৈরী করেছিলেন।
একবার মেহেরপুরের সীমান্ত গ্রাম বুড়িপোতা থেকে একটি খবর এলো। অনেকটা অস্পষ্ট-অগোছালো, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। তিনি খবরটি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন সম্পাদনা এবং সুন্দর হেডিং দেওয়ার জন্য। ছাকেন আলী নামের একজন দারোগা গেছেন গ্রামের একটি মামলা তদন্তে। সেখানে উপস্থিত হন গ্রামেরই একজন প্রবীণ ও জনপ্রিয় ইউপি সদস্য। তিনি ছাকেন আলীকে স্যার না বলে ছাকেন মিয়া নামে ডাকেন। এতে ছাকেন আলী ঐ প্রবীণ ইউপি সদস্যকে জনসম্মুখে হেনস্থা করেন এবং আরো দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। আমি সংবাদটি সম্পাদনা করলাম। কিন্তু হেডিং সম্পাদকের পছন্দ হল না। তিনি নিজেই হেডিং দিলেন “ছাকেন মিয়াকে স্যার না বলায়-” (দ্রষ্টব্য: আমার লেখা বই “কলম, ক্যামেরা ও মানুষ” পৃষ্ঠা-৩১-৩৪) । চৌধুরী সাহেব খবরে সুন্দর হেডিং দিয়ে খবরটিকে টাটকা ও সুন্দর করে তুলতেন। কারণ হেডিং হলো খবরের অলংকার।
চৌধুরী সাহেবের মধ্যে ছিল নিউজম্যানশীপ- খবরে নেতৃত্ব দানের অসাধারণ গুণ। কাগজটিকে জনপ্রিয় করতে যা যা করার দরকার তা তিনি করতেন। দূর গ্রাম থেকে আসা খবর দাতাদের তিনি আপ্যায়ন করতেন। খবর পাঠানোর খরচা দিতেন। বছর শেষে তাঁদের জন্য সমাবেশ ও ভোজের আয়োজন করতেন। এভাবে তিনি একজন জনপ্রিয় সম্পাদকই হননি সংবাদাতাদের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ইস্পাত অফিসে আসা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্বাদের কাগজ তিনি সংবাদদাতাদের পড়তে দিতেন। তিনিও নিয়মিত বিভিন্ন ধরণের খবরের কাগজ পড়তেন। বিভিন্ন কাগজ প্রকাশের কৌশল দেখে নিজের কাগজের নিজস্ব ষ্টাইল গ্রহণ করতেন। সেকারণে তাঁর সম্পাদিত ইস্পাত ঠিক ইস্পাত কঠিন পত্রিকায় পরিণত হয়েছিল।
১৯৭৯-৮১ পর্যন্ত ইস্পাত পত্রিকায় বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আমি যা শিখেছিলাম তা পূঁজি করে পরবর্তিতে দৈনিক সংবাদে জনপ্রিয় সাংবাদিকের সুনাম পেয়েছিলাম। ঐ পত্রিকার মফস্বল ডেস্কেও যোগদানের সুযোগ হয়েছিল।
ওয়ালিউল বারী চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদে আমি খুবই মর্মাহত হয়েছি। ঐসময় আমিও অসুস্থ ছিলাম। চৌধুরী সাহেবের মৃত্যুতে কুষ্টিয়ার সাংবাদিকেরা একজন অভিভাবক হারিয়েছেন যা সহজে পূরণীয় নয়। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।