লোক দেখানো লৌকিকতা

0
790

কানিজ ফাতিমা

একজন মসজিদের ইমামকে মুসল্লীদের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। দীর্ঘ চার দশকের একজন ইমামের ইমামতির জীবনে মুখোমুখি হওয়া এক মুসল্লীর একটি প্রশ্ন প্রায়ই মনে পড়ে।

তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, হুজুর হজ¦ তো ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের চতুর্থ, তাই না? ইমাম সাহেব বলেছিলেন, জি¦ হ্যাঁ। তারপর তিনি বললেন, তাহলে কেউ হজ¦ করে এসে যদি নামের আগে আলহাজ্ব লাগাতে পারে, তবে যারা নামায পড়েন তাদের নামের আগে আল-মুসল্লী এবং যারা রোজা রাখেন তাদের নামের আগে আস-সায়েম যোগ করা যাবে না কেন? সেদিন তার প্রশ্নের উদ্দেশ্য টা বুঝতে পারিনি। বুঝেছিলাম বেশ কিছুদিন পর। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ। মাদ্রাসার জন্য দানের টাকা আদায়ের রশিদে দাতার নামের শুরুতে আলহাজ্ব বা হাজী না লেখায় অনেকেই রাগ করেন, এমন মানুষও দেখেছি। ফলে ওই মুসল্লীর মতো আমার মনেও প্রশ্ন হলো,নামের পদবী হিসেবে হাজী শব্দ ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে।

হজ¦ একটা ইবাদত। সেটাকে পরিচিতির চিহ্ন ও টাইটেল হিসেবে নামের আগে যোগ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত? নামের আগে আলহাজ্ব যোগ করাটা রিয়া বা লৌকিকতার পরিচয়কেই প্রকাশ করে, যা একজন হাজীর জান্নাত প্রাপ্তিকে অসম্ভব করে তুলতে পারে।

সুনাম বা খ্যাতি অর্জনের লক্ষ্যে অথবা মানুষকে দেখানোর জন্য এক কথায় পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে যে ইবাদত করা হয়, তাকে ইসলামি শরীয়তের পরিভাষায় রিয়া বলা হয়। আর রিয়াকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছোট শিরক বলে আখ্যায়িত করেছেন।

হযরত শাদ্দাত ইবনে আওস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যাক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে সে শিরক করে আর যে মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে রোজা রাখে সে শিরক করে এবং যে মানুষ দেখানোর উদ্দেশ্যে দান করে, সে শিরক করে। -মুসনাদে আহমদ

নাম তো সেটাই, যেটা সন্তান জন্মের পর বাবা-মা বা পরিচিত জন তার পরিচিতির জন্য রেখে থাকেন। তবে উত্তম নাম রাখতে অবশ্যই আমাদের সচেতন থাকতে হবে। পরবর্তীতে পেশাগত বা বংশীয় পরিচিতির কারণে আনেকের নামের পূর্বে অথবা পরে পদবী সংযুক্ত করতে দেখা যায়। যেমন- ডক্টর (পি এইচ ডি ডিগ্রীধারি), প্রৌকোশলী, ডাক্তার, অধ্যাপক, শেখ, কোরাইশী, সর্দার প্রভৃতি। এ গুলো আইনে বিধানে অনুমোদিত । নিজেকে পরিচিত করা ইদানিং সবচেয়ে সমাজের বড় ব্যাধি রুপে দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে প্রেস, প্রিন্টিং, অবাধ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজ প্রান্তিক পর্যায়ের হাতের মুঠোই। সে কারণে যে যেমন ইচ্ছে শালিন, অশালিন মতামত, ছবি পোষ্ট, নেতা, কর্তা ব্যাক্তির সাথে ছবি উঠে দেয়ালে বা বিল বোর্ডে সাটিয়ে দেওয়া হয়।

সবই লোক দেখানো বললে হয়ত অবান্তর বলা হবে না। সংগত কারণেই জীবনের দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে হজ¦ করার পরে পিতা-মাতার রাখা নামের সঙ্গে নতুন পদবী যোগ করার অর্থ যদি হয় পুনঃনাম করন আর উদ্দেশ্য যদি হয় সামাজিক স্বীকৃতি আদায়, তা হলে তাকে রিয়া বা লৌকিকতা না বলে আর কিইবা বলা যেতে পারে? আর এই লৌকিকতা হয়তো লোক-সমাজে সম্মান এনে দিতে পারে ;কিন্তু সেটা মহান আল্লাহর দরবারে বড় লাঞ্ছনার কারন হয়ে উঠবে।

হযরত জুনদুব (রাঃ) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে ব্যাক্তি সুখ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে কোনো আমল করে,আল্লাহ তায়ালা তার দোষ-ত্রুটি মানুষের সামনে প্রকাশ করে দেবেন। আর যে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোনো আমল করবে আল্লাহ তায়ালা তার সঙ্গে লোক দেখানোর মতো আচরণ করবেন। আমলের সওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হবে। -সহীহ বুখারী ও মুসলিম

এ ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের একটি বানী বিশেষ ভাবে স্বরনীয়, ইরশাদ হয়েছে, যে আখেরাতের ফসল কামনা করে আমি তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি। আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তা থেকে কিছু দিই; কিন্তু তার জন্য আখেরাতে কোনো অংশই থাকবে না।-সূরা আশ শূরাঃ ২০

সর্বপরি আমরা রিয়া থেকে যেন মুক্ত হয়ে জীবন-কার্যাদি পরিচালনা করতে পারি সেই কামনাই করব সৃষ্টিকর্তার নিকট।

 

কানিজ ফাতিমা
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়